পঞ্চগড়ে আহমদিয়াদের ওপর হামলার ঘটনায় মামলা বেড়ে ১৩, গ্রেপ্তার ১৩৫

হামলায় গুঁড়িয়ে দেওয়া ঘরের টিন এদিক-ওদিক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। শুক্রবার পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার সোনাচান্দি এলাকার রফিক আফ্রাদের বাড়িতেছবি: প্রথম আলো

পঞ্চগড়ে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের (কাদিয়ানি) সালানা জলসা বন্ধের দাবিতে আন্দোলন ও সংঘর্ষের ঘটনার পর থেকে প্রতিদিনই করা হচ্ছে নতুন নতুন মামলা। আজ বুধবার সকাল পর্যন্ত মোট ১৩টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় এ পর্যন্ত মোট ১৩৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যাপক অভিযান ও নজরদারিতে জেলা শহরের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। আগের মতোই খুলতে শুরু করেছে দোকানপাট, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান।

ঘটনার পর থেকে গতকাল মঙ্গলবার বিকেল পর্যন্ত হওয়া ১০টি মামলায় মোট ১৩০ জনকে গ্রেপ্তার করছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এরপর রাতভর অভিযান চালিয়ে আরও ৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। মঙ্গলবার রাতে আরও তিনটি মামলা করা হয়। এতে মোট ১৩টি মামলায় গ্রেপ্তারের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৩৫। জেলা শহরের আশপাশের এলাকাগুলোতে গ্রেপ্তার অভিযান চলায় মানুষের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। তবে নিরপরাধ কাউকে গ্রেপ্তার করে হয়রানি করা হবে না বলে পুলিশের পক্ষ থেকে আশ্বস্ত করা হয়েছে।

আরও পড়ুন

হামলা, সংঘর্ষ ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গত শনিবার রাতে পঞ্চগড় সদর থানায় আহমদিয়া সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে একটি এবং পুলিশের পক্ষ থেকে দুটি মামলা করা হয়। এরপর রোববার রাতে পঞ্চগড় সদর থানায় র‍্যাব বাদী হয়ে একটি এবং পুলিশ বাদী হয়ে আরও দুটি মামলা করে। এরপর সোমবার রাতে জেলার বোদা থানায় আহমদিয়া সম্প্রদায় ও পুলিশ দুটি এবং পঞ্চগড় সদর থানায় আরও দুটি মামলা করে পুলিশ। এরপর মঙ্গলবার রাতে পঞ্চগড় সদর থানায় আরও তিনটি মামলা করে পুলিশ। এতে সদর থানার মামলার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১১টি এবং বোদা থানায় মামলার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২টি। এসব মামলায় আসামি প্রায় ১১ হাজার বলে জানা গেছে।

এর আগে শনিবার রাতে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের তরুণ জাহিদ হাসানকে হত্যার অভিযোগে পঞ্চগড় পৌর শহরের দক্ষিণ রাজনগর এলাকার ঈসমাইল হোসেন (২৫) এবং তুলারডাঙ্গা এলাকার মো. রাসেলকে (২৮) গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তার দুজনই প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জাহিদ হাসানকে পিটিয়ে হত্যার কথা স্বীকার করেছেন বলে পুলিশ দাবি করেছে।

এ ছাড়া শনিবার রাতে মোটরসাইকেলে চেপে শহরে ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব ছড়ানোর অভিযোগে পঞ্চগড় পৌর যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক ফজলে রাব্বী (৩০) এবং ফেসবুকে গুজব ছড়ানোর অভিযোগে তেঁতুলিয়া উপজেলার সাতমেড়া এলাকার রাব্বী ইমনকে (২৬) গ্রেপ্তার করা হয়। একই ঘটনায় দেবীগঞ্জ উপজেলার সোনাহার ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও বিএনপি নেতা রহিমুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানা গেছে। গ্রেপ্তার হওয়া অন্য সবার নাম এখনো জানা যায়নি।

আরও পড়ুন

জেলা পুলিশ সুপার এস এম সিরাজুল হুদা আজ বুধবার সকালে বলেন, পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সদস্যদের নিয়ন্ত্রণে জেলার পরিবেশ বর্তমানে স্বাভাবিক আছে। অপরাধীদের ধরতে পুলিশ ও যৌথ বাহিনী কাজ করছে। তবে ভিডিও ফুটেজ দেখে, সুনির্দিষ্ট গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে এবং যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে আসামিদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। এ ঘটনায় কোনো নিরপরাধ সাধারণ মানুষকে হয়রানি করা হবে না।

প্রসঙ্গত, পঞ্চগড় শহরের উপকণ্ঠে আহমদনগর এলাকায় আহমদিয়া জামাতের জলসা বন্ধের দাবিতে গত শুক্রবার দুপুরে জুমার নামাজের পর পঞ্চগড় শহরের বিভিন্ন মসজিদ থেকে মিছিল বের করা হয়। মিছিল নিয়ে বিক্ষোভকারীরা শহরের চৌরঙ্গী মোড়ে সমবেত হন। সেখান থেকে তাঁরা মিছিল নিয়ে করতোয়া সেতুর দিকে যেতে চাইলে পুলিশ তাঁদের থামিয়ে দেয়। একপর্যায়ে বিক্ষোভকারীরা ছড়িয়ে–ছিটিয়ে শহরের বিভিন্ন অলিগলিতে ঢুকে পড়েন। কিছুক্ষণ পর চৌরঙ্গী মোড়সংলগ্ন সিনেমা হল সড়ক থেকে একদল বিক্ষোভকারী মিছিল নিয়ে এসে পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুড়তে থাকে। তখন পুলিশ ধাওয়া দিলে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ বাধে। একদল বিক্ষোভকারী আহমদনগর এলাকায় গিয়ে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের অন্তত শতাধিক বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর করে। সন্ধ্যা পর্যন্ত দফায় দফায় এ পাল্টাপাল্টি হামলা চলে। এ ঘটনায় দুই তরুণ নিহত, পুলিশ, সাংবাদিকসহ শতাধিক মানুষ আহত হন।

সংঘর্ষের একপর্যায়ে পুলিশ, বিজিবি ও র‍্যাবের সদস্যরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে কাঁদানে গ্যাসের শেল ও রাবার বুলেট ছোড়েন। পরে প্রশাসনের হস্তক্ষেপে আহমদিয়াদের জলসা বন্ধ ঘোষণা করা হয়।

আরও পড়ুন

এদিকে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনার পর থেকেই আহমদিয়া সম্প্রদায়ের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষেরা কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন। বাড়িঘরে কোনো কিছু না থাকায় অনেকেই নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের দূরদূরান্তের স্বজনদের বাড়িতে পাঠিয়েছেন। যাঁদের যাওয়ার কোনো জায়গা নেই, তাঁরা দিনের বেলা এসব পুড়ে যাওয়া বাড়িঘরেই অবস্থান করছেন এবং আহমদিয়া সম্প্রদায়ের জামাত থেকে তাঁদের খাওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। তাঁদের মধ্যে অনেকেই মসজিদেও রাত কাটাচ্ছেন।