সিলেটের আদালত চত্বরে আসামিদের ওপর একের পর এক হামলা, সমালোচনা

সাংবাদিক এ টি এম তুরাব হত্যা মামলায় সিলেটের সাবেক অতিরিক্ত উপকমিশনার সাদেক কাউসার দস্তগীরকে আদালতে হাজির করা হয়। বৃহস্পতিবার বিকেলে
ছবি: প্রথম আলো

সিলেটের আদালত চত্বরে আসামিদের ওপর একের পর এক হামলার ঘটনা ঘটেছে। গত ২৪ আগস্ট থেকে গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সাবেক বিচারপতি, পুলিশ কর্মকর্তা ও আওয়ামী লীগের নেতাসহ ছয়জনের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় সিলেটসহ দেশব্যাপী সমালোচনা চলছে। জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা বলছেন, আসামিকে নির্যাতন কিংবা হেনস্তা করা ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়। এমন হামলা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। যাঁরা এমন অপরাধে জড়িত, তাঁদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা গেলে হামলা ঠেকানো সম্ভব।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর হত্যাসহ বিভিন্ন মামলায় সিলেটে বেশ কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা, সাবেক বিচারপতি ও পুলিশ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আদালতে নেওয়ার সময় আদালত চত্বরে কারও কারও ওপর হামলা বা মারধরের মতো ঘটনা ঘটেছে। জুতা নিক্ষেপের ঘটনাও হয়েছে। এসব নিয়ে শুরু হয়েছে তুমুল সমালোচনা।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে আদালত চত্বরে এক পুলিশ কর্মকর্তা ও এক আওয়ামী লীগ নেতা হামলার শিকার হয়েছেন। এর আগে গত ২৪ আগস্ট সাবেক এক বিচারপতি এবং গত ২৮ নভেম্বর আওয়ামী লীগপন্থী এক পরিবহন নেতাসহ তিনজনের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। গুরুতর আহত হয়ে তাঁদের মধ্যে পাঁচজন সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নেন।

এসব হামলা না ঠেকাতে পারার বিষয়টি ‘রাষ্ট্রের ব্যর্থতা’ হিসেবে মনে করেন সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এমাদ উল্লাহ শহীদুল ইসলাম। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘আমরা মনে করি, একজন মানুষ যখন রাষ্ট্রের হেফাজতে, তখন তাঁর নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। সে অপরাধী কি না, সেটা বিচার হবে। বিচারের পরে তাঁর শাস্তি হবে অথবা খালাস হবে, রায় হবে। তত দিন পর্যন্ত যাঁরা বিচারপ্রত্যাশী, তাঁদের ধৈর্য ধরা উচিত। এ হামলার দায়দায়িত্ব রাষ্ট্রকেই বহন করতে হবে, প্রশাসনকে বহন করতে হবে।’

পুলিশ, আইনজীবী ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সূত্রে জানা গেছে, সিলেটে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে সাংবাদিক এ টি এম তুরাব হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার তৎকালীন সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার সাদেক কাউসার দস্তগীরকে বৃহস্পতিবার বিকেলে আদালত প্রাঙ্গণে নিয়ে আসা হয়। আদালতে তৃতীয় তলায় সিঁড়ি দিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় তাঁকে অনেকে কিলঘুষি মারেন। এ সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তাঁদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেন। পরে আদালতে শুনানি শেষে বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে তৃতীয় তলা থেকে নিয়ে যাওয়ার সময়ও কিলঘুষির শিকার হন সাদেক কাউসার।

এদিন সিলেটে ছাত্রদল নেতা খুনের মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া বালাগঞ্জ উপজেলার পশ্চিম গৌরীপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আমির হোসেনও বেলা সোয়া তিনটার দিকে আদালত প্রাঙ্গণে বেধড়ক মারধরের শিকার হয়েছেন।

প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ জানিয়েছে, সংঘবদ্ধ বেশ কয়েকজন ব্যক্তি আমির হোসেনকে বেধড়ক কিলঘুষি ও লাথি দেন। হামলায় আমির হোসেনের মাথা ফেটে রক্ত বের হয় এবং শরীরের নানা স্থানে আঘাত পান। পরে পুলিশ সদস্যরা তাঁকে উদ্ধার করে হাজতে নিয়ে যান। বিকেল পৌনে পাঁচটার দিকে সেখান থেকে তাঁকে সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।

ঘটনার পর সিলেটের বালাগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. ফয়েজ আহমদ প্রথম আলোকে জানান, আমির হোসেনকে আদালতে পাঠানো হলে হামলার শিকার হন। পরে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। সুস্থ হলে পরবর্তী সময়ে আদালতে পাঠানো হবে।

এর আগে সীমান্ত দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় সিলেটের কানাইঘাট থেকে আটক হওয়ার পর সিলেটের আদালতে তোলার সময় গত ২৪ আগস্ট সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছিল।

আদালতে প্রবেশের সময় আদালত প্রাঙ্গণে থাকা দলবদ্ধ কিছু ব্যক্তি শামসুদ্দিন চৌধুরীকে বেধড়ক কিলঘুষি মারেন। শারীরিকভাবে তাঁকে লাঞ্ছিতও করা হয়। অনেকে ডিম ছোড়ার পাশাপাশি জুতাও নিক্ষেপ করেন। কেউ কেউ শামসুদ্দিন চৌধুরীর নাম উল্লেখ করে ‘ভুয়া ভুয়া’সহ বিভিন্ন কটূক্তিমূলক স্লোগান দেন। দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা তখন কোনোরকমে শামসুদ্দিন চৌধুরীকে আদালত ভবনে ঢোকান। পরে আদালতের কার্যক্রম শেষে শামসুদ্দিন চৌধুরীকে নিয়ে ফেরার সময় সেনাবাহিনী থাকায় পরিস্থিতি অনেকটা শান্ত ছিল। তবে আদালতে ঢোকার সময় মারধরের কারণে শামসুদ্দিনের শরীরে বিভিন্ন স্থানে জখমের পাশাপাশি স্কোটাল ইনজুরি (অণ্ডকোষে আঘাত) হয়। ওই রাতেই তাঁর অস্ত্রোপচার হয়। এ জন্য বেশ কয়েক দিন তাঁকে ওসমানী হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হয়।

একইভাবে সিলেট নগরের শাহপরান এলাকার যুবদল কর্মী বিলাল আহমদ মুন্সী হত্যার ঘটনায় গ্রেপ্তার তিন আসামিকে গত ২৮ নভেম্বর আদালতে তোলার সময় হামলার ঘটনা ঘটেছে। হামলাকারীরা আসামিদের মাথা ও শরীরের স্পর্শকাতর স্থানে কিল, চড়-থাপ্পড় ও লাথি মারেন। কেউ কেউ আসামিদের জুতাপেটাও করেন। এ সময় গুরুতর আহত হওয়ায় তাঁরা ওসমানী হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। হামলার শিকার ওই তিন আসামি হচ্ছেন আওয়ামী লীগপন্থী হিসেবে পরিচিত সিলেট জেলা হিউম্যান হলার চালক শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মো. রুনু মিয়া (টেম্পো মঈন), রাসেল আহমদ ও জাকির।

এসব হামলার বিষয়ে সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক গোলাম ইয়াহ-ইয়া চৌধুরী (সুহেল) জানান, এমন হামলা দেশের কোনো সুস্থ ও বিবেকবান মানুষই চান না। আইন কেউ নিজের হাতে তুলে নিক, এটা কোনো স্বাভাবিক মানুষের কাম্য নয়। কিন্তু যেহেতু অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে এমনটা ঘটছে, তাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও নিরাপত্তাবলয় জোরদার করা উচিত।

ইয়াহ-ইয়া চৌধুরী আরও বলেন, ‘পুলিশ যেহেতু দেশের বর্তমান অবস্থাটা জানে। কিন্তু তারা পর্যাপ্ত পরিমাণ নিরাপত্তা না দিয়ে আসামিদের এভাবে আদালতে আনা ঠিক নয়। বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরীর ওপর হামলার পর আমরা বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বৈঠকে বিষয়টি উপস্থাপন করেছি। আমরা বলেছি, যেহেতু দেশের পরিস্থিতি এমন এবং মানুষজন বিক্ষুব্ধ আছে এসব মানুষের (আসামি) ওপরে, সুতরাং যাঁদের ওপর মানুষ বিক্ষুব্ধ আছে, পুলিশ তাঁদের আদালতে আনার সময় যথেষ্ট নিরাপত্তাবলয় তৈরি করেই আনা উচিত। কারণ, সময়টা এখন স্বাভাবিক নয়।’

তবে পুলিশ দাবি করছে, অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী আদালত প্রাঙ্গণে হামলার শিকার হওয়ার পর থেকেই গুরুত্বপূর্ণ কোনো আসামিকে আদালতে নেওয়ার সময় অতিরিক্ত নিরাপত্তা নেওয়া হয়ে থাকে। এরপরও বিক্ষুব্ধ ব্যক্তিরা কোনো কোনো ক্ষেত্রে আক্রমণের চেষ্টা চালান। তবে পুলিশ তা ঠেকাতে আপ্রাণ চেষ্টা করে। এ বিষয়ে সিলেট মহানগর পুলিশের কমিশনার মো. রেজাউল করিম প্রথম আলোকে বলেন, এটা ঠিক করেনি তারা (হামলাকারী)। আইনের প্রতি সবার শ্রদ্ধাশীল থাকা উচিত। আইন কখনোই নিজের হাতে তুলে নেওয়া উচিত নয়। তবে এডিসি দস্তগীরের (পুলিশ কর্মকর্তা সাদেক কাউসার দস্তগীর) সময় কিছু হয়নি। এ ছাড়া আসামিদের আদালতে তোলার সময় নিরাপত্তাব্যবস্থাও আগের চেয়ে বাড়ানো হয়েছে বলে তিনি জানিয়েছেন।