করতোয়ার আউলিয়ার ঘাট
সেতুর কাজ দৃশ্যমান হয়নি
গত বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর আউলিয়া ঘাটে নৌকা ডুবে ৭২ জনের মৃত্যু হয়। নিখোঁজ রয়েছেন একজন।
করতোয়া নদীর আউলিয়ার ঘাটে পানি শুকিয়ে গেছে। খেয়া নৌকা চলাচল বন্ধ। মানুষ পারাপারের জন্য ঘাটের ইজারাদার মাঝনদীতে তৈরি করেছেন বাঁশের সাঁকো। নদীর দুই পাশে চাষ হয়েছে বোরো ধান। দেখে বোঝার উপায় নেই, এই আউলিয়ার ঘাটেই ৬ মাস আগে নৌকাডুবিতে ৭২ জনের মৃত্যু হয়েছে।
পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার মাড়েয়া-বামনহাট ইউনিয়নে আউলিয়ার ঘাটের অবস্থান। গত বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর সেখানে নৌকাডুবির ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনার পর স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যরা জানিয়েছিলেন, সেখানে দ্রুত সেতু নির্মাণের কাজ শুরু হবে। তবে ছয় মাসেও সেতু নির্মাণের দৃশ্যমান কার্যক্রম দেখা যায়নি।
মাঝেমধ্যে নদীর পাড়ে গিয়ে পাথর-বালু তোলা লোকজনকে বাবার কথা বলি। বাবার পরনের কাপড়ের বর্ণনা দিয়ে আসি।
তবে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) কর্তৃপক্ষ বলছে, করতোয়া নদীর আউলিয়ার ঘাটে ৮১০ মিটার দৈর্ঘ্যের ‘ওয়াই’ আকৃতির একটি সেতু নির্মাণের দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। দরপত্র জমা দেওয়ার শেষ তারিখ আগামী ২৭ এপ্রিল। মে মাসে সেতু নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন হতে পারে।
গত বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর দুপুরে বোদা উপজেলার মাড়েয়া বাজারের পাশে করতোয়া নদীর আউলিয়া ঘাট থেকে শতাধিক মানুষ নিয়ে শ্যালো ইঞ্জিনচালিত একটি নৌকা বড়শশী ইউনিয়নের বদেশ্বরী মন্দিরের দিকে রওনা হয়। যাত্রীদের অধিকাংশই বদেশ্বরী মন্দিরে মহালয়ার অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যাচ্ছিলেন। ঘাট থেকে কিছু দূর যাওয়ার পর নৌকাটি ডুবে যায়। এ ঘটনায় ৭১ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। তবে এখনো নিখোঁজ সরেন্দ্রনাথ বর্মণ (৬৩)। তাঁর বাড়ি বোদা উপজেলার সাকোয়া ইউনিয়নের নগর সাকোয়া-ডাঙ্গাপাড়া এলাকায়।
নৌকাডুবির ঘটনার ৪ দিন পর ২৯ সেপ্টেম্বর নৌকাডুবিতে নিহত ব্যক্তিদের স্বজনদের হাতে প্রধানমন্ত্রীর পাঠানো অর্থ ও ত্রাণ সহায়তা প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে রেলমন্ত্রী ও পঞ্চগড়-২ আসনের সংসদ সদস্য নূরুল ইসলাম জানিয়েছিলেন, আউলিয়ার ঘাটে ইতোমধ্যে ব্রিজ (সেতু) হওয়ার সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। তখন বলা হয়েছিল, ডিসেম্বর বা জানুয়ারিতে সেতুর কাজ শুরু হবে।
গত বৃহস্পতিবার আউলিয়ার ঘাটে গিয়ে দেখা যায়, নদীর পানি শুকিয়ে গেছে। পানিপ্রবাহ কম। নদীর ভেতর বাঁশ ও কাঠের সাঁকো। লোকপ্রতি পারাপারের জন্য নেওয়া হচ্ছে ১০ টাকা করে। এ ছাড়া মোটরসাইকেল ও ভ্যান পারাপারের জন্য নেওয়া হচ্ছে ১০ টাকা করে। সেখানে ইজারাদারের প্রতিনিধি হিসেবে মো. মাসুম নামের এক কিশোর লোকজনের কাছ থেকে টাকা আদায় করছে। মাসুম জানায়, দুই মাস ধরে মানুষ বাঁশের সাঁকো দিয়ে চলাচল করছে। তবে পানি বেড়ে গেলে আবারও নৌকাতে চলাচল করবে। প্রতিদিন ২০০ জনেরও বেশি মানুষ এই সাঁকো দিয়ে পারাপার হয়।
মাড়েয়া এলাকার বাসিন্দা মোমিনুর ইসলাম (৪৫) বলেন, ‘সেই ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি আউলিয়ার ঘাটে ব্রিজ (সেতু) হবে। কিন্তু বাস্তবে আর ব্রিজ দেখলাম না। সেতু না থাকায় এখানে নৌকা ডুবে ৭২ জন মানুষ মারা গেল। তখন মন্ত্রীসহ প্রশাসনের লোকজন বলেছিলেন যে খুব তাড়াতাড়ি ব্রিজ হয়ে যাবে। এখনো তো কিছুই দেখছি না?’
নৌকাডুবিতে নিখোঁজ সরেন্দ্রনাথ বর্মনের বড় ছেলে স্বপন কুমার বর্মন বলেন, ‘৭১ জন মানুষের লাশ পাওয়া গেল। শুধু আমার বাবার কোনো সন্ধান পেলাম না। এর চেয়ে দুঃখ আর কী আছে? ধর্মের বিধান অনুযায়ী ঘটনার ২৭ দিন পর বাবার প্রতীকী দাহ (খড়ের তৈরি বিশেষ বস্তু দাহ) করেছি। পরে শ্রাদ্ধও করেছি। এখনো মাঝেমধ্যে নদীর পাড়ে গিয়ে পাথর-বালু তোলা লোকজনকে বাবার কথা বলি। বাবার পরনে থাকা কাপড়ের বর্ণনা দিয়ে আসি। কিন্তু কোথাও থেকে কোনো খবর পাই না।’
ইতিমধ্যে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। এপ্রিল মাসের শেষ দিকে অথবা মে মাসের শুরুর দিকে সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা যাবে।
এলজিইডি পঞ্চগড় জেলা কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শামছুজ্জামান বলেন, আউলিয়ার ঘাটে ৮১০ মিটার দৈর্ঘ্যের একটি ‘ওয়াই’ আকৃতির সেতু নির্মাণ করা হবে। ইতিমধ্যে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। আশা করছি আগামী এপ্রিল মাসের শেষ দিকে অথবা মে মাসের শুরুর দিকে সেতু নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা যাবে।
আউলিয়ার ঘাটে নৌকাডুবির ঘটনার প্রায় সাড়ে পাঁচ মাস পর নৌ অধিদপ্তরের দায়ের করা মামলায় ১৪ মার্চ ঘাট ইজারাদার আবদুল জব্বার (৫৮) ও নৌকার মাঝি বাচ্চু মিয়াকে (৫২) গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এর আগে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি নৌ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বিশেষ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত-২-এ তিনজনকে আসামি করে একটি মামলা করেন।