ঝড়ে নুয়ে পড়া ধানগাছে ‘হুরা বাঁধছেন’ কৃষক

দল বেঁধে নুয়ে পড়া ধানগাছ সোজা করছেন কয়েকজন। সম্প্রতি ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার গড়েয়া এলাকায়ছবি: প্রথম আলো

পাকা সড়কটির ডানে-বাঁয়ে সবুজ ধানখেত। কোথাও কোথাও ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে এসব খেতের ধানগাছ, আবার কোথাও দল বেঁধে নুয়ে পড়েছে মাটিতে। এসব খেতের ধান কয়েক দিনের মধ্যে ঘরে তোলার উপযুক্ত হতো। ফলন যাতে না কমে, তাই নুয়ে পড়া ধানগাছগুলো সোজা করছেন কৃষকেরা।

জানতে চাইলে রোশনি বর্মণ নামের এক কৃষক বলেন, ‘ধানগাছগুলাক হুরা বাঁধে না দিলে ফলন কমে যাইবে। হুরা বাঁধে দেওয়া মানে হইল, মাটির ধানগাছ তুলে গোছা বাঁধে দেওয়া।’ এটা কীভাবে শিখলেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বললেন, ‘কৃষি অফিসের লোক আসিয়া দেখায় দিল।’

ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার গড়েয়া এলাকার চিত্র এটি। ঘূর্ণিঝড় দানার প্রভাবে অঞ্চলটিতে গত বৃহস্পতিবার টানা বৃষ্টি শুরু হয়। মাঝেমধ্যে বৃষ্টির সঙ্গে চলে দমকা হাওয়া। এতে আমন খেতের ধান নুয়ে পড়েছে।

ধানগাছের নুয়ে পড়ার অবস্থাটিকে আশঙ্কাজনক বলে জানান কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ঠাকুরগাঁও কার্যালয়ের অতিরিক্ত উপপরিচালক আলমগীর কবির। তাঁর মতে, জমিতে পানি জমে থাকলে ঝড়ে নুয়ে পড়া ধানগাছে পচন দেখা দিতে পারে। আবার ধানের শীষেও রোগ ছড়াতে পারে। এ সময় পোকার আক্রমণ বেড়ে যায়। ‘লজিং আপ’ পদ্ধতির মাধ্যমে এসব সমস্যার মোটামুটি সমাধান করা যায়। গ্রামের কৃষক এটিকেই হুরা বেঁধে দেওয়া বলছেন।

‘লজিং আপ’ পদ্ধতি নিয়ে জানতে চাইলে আলমগীর কবির বলেন, পদ্ধতিটি অত্যন্ত সহজ। ‘লজিং’–এর অর্থ হলো নুয়ে পড়া। আর ‘আপ’-এর অর্থ নুয়ে পড়লে ধানগাছ তুলে বেঁধে দেওয়া। চার-পাঁচটি ধানের গোছা একসঙ্গে করে ধানের গোছার একটি পাতা দিয়ে গাছগুলোকে একসঙ্গে বেঁধে দিলেই তা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। আর বাতাসে হেলে পড়ে না।’

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ঠাকুরগাঁও কার্যালয় সূত্র জানায়, জেলায় চলতি মৌসুমে ১ লাখ ৩৭ হাজার ২৮০ হেক্টর জমিতে আমন ধানের আবাদ হয়। এখন মাঠে ২ শতাংশ জমির ধান থোড় পর্যায়ে, ৩৫ শতাংশ জমির ধান ফুল পর্যায়ে, ৫২ শতাংশ ক্ষীর পর্যায়ে, পরিপক্ব পর্যায়ে আছে ৭ শতাংশ জমির ধান। আর ৪ শতাংশ জমির ধান কেটে ঘরে তুলেছেন কৃষক। ফলে অধিকাংশ জমির ফসলই ঘরে ওঠেনি।

সরেজমিন দেখা যায়, ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার গড়েয়া, রুহিয়ার ঘনিমহেশপুর, সালন্দরের শিংপাড়া, কচুবাড়ি, জামালপুর, রহিমানপুরসহ বিভিন্ন এলাকার ধানগাছ মাটিতে নুয়ে পড়েছে। গড়েয়া গোপালপুর গ্রামের কৃষক জগদীশ বর্মণ বলেন, তাঁর তিন বিঘা জমিতে ধান আছে। এর মধ্যে দেড় বিঘা জমির ধানগাছ মাটিতে পড়ে গেছে। সব ধানগাছ হুরা করে তুলে দিয়েছেন। তিনি বলেন, দুজন শ্রমিকের মজুরি ৭০০ টাকা। তা এক মণ ধানের দামের চেয়েও কম। কিন্তু নুয়ে পড়া ধানগাছ তুলে না দিলে ফলন একেবারে কমে যেতে পারে।

সালন্দর শিংপাড়া এলাকার কৃষক আল আমিন বলেন, তাঁর পাঁচ বিঘা জমির মধ্যে তিন বিঘার ধান ঝড়ে নুয়ে পড়েছে। চারজন শ্রমিক নিয়ে এক দিনে দুই বিঘা জমির ধানগাছ সোজা করেছেন তিনি। বাকিগুলোও তুলে দেবেন।

সদর উপজেলার কচুবাড়ি এলাকায়ও আমন ধানের গাছ নুয়ে পড়েছে। সেখানে কথা হয় চাষি প্রদীপ রায়ের সঙ্গে। তিনি জানান, দুই থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যে ধান কাটা শুরু হতো। এমন সময় বাতাসে ধানগাছ মাটিতে পড়ে গেছে। নিচে পড়ে থাকলে ধানগাছে কয়েক দিনের মধ্যেই পোকায় আক্রমণ করবে। ফলে ফলন কমে যাবে।

ঠাকুরগাঁও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক সিরাজুল ইসলাম বলেন, ঘূর্ণিঝড় দানার প্রভাবে বৃষ্টি আর ঝোড়ো হাওয়ায় কোথাও কোথাও ধানগাছ মাটিতে পড়ে গেছে। নুয়ে পড়ার কারণে এ পর্যায়ের জমির ধানে ক্ষতির আশঙ্কা আছে। মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা কৃষকের জমিতে গিয়ে নুয়ে পড়া ধানগাছ সোজা করার পদ্ধতি শিখিয়ে দিচ্ছেন। এতে ক্ষতির আশঙ্কা কমে আসবে।