‘জিনিসপত্রের দাম অতিরিক্ত, গরিব বাঁচত কিলা’
ইউছুফ আলীর বাড়ি হবিগঞ্জের বাহুবলে। প্রায় ছয় মাস ধরে কাজের উদ্দেশ্যে মৌলভীবাজারে আছেন। শহরতলিতে পাঁচজন মিলে একটা ঘর ভাড়া করে থাকেন। ঘরভাড়া ২ হাজার ২০০ টাকা। ভাড়া, খাওয়াসহ প্রতিদিন নিজের খরচ ২০০ টাকার মতো। বাড়িতে স্ত্রী, পুত্র-কন্যা মিলে আছে চারজন। তাদেরও খরচ দিতে হয়; কিন্তু এখন বাড়িতে আর টাকা পাঠাতে পারেন না। এ বিষয়ে ইউছুফ আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রতিদিন কাজ নেই। পাঁচ দিন ধরি আই আর যাই, কাম নাই। হাওলাত করি চলি। নিজেও চলতাম পারি না। বাড়িতও টাকা পাঠাইতাম পারি না।’
মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে মৌলভীবাজার শহরের চৌমোহনা চত্বরে ইউছুফ আলীসহ ১০-১২ জন শ্রমিকের সঙ্গে কথা হয়। প্রায় সবাই জানালেন, এখন কাজের সংকট। কাজের উদ্দেশ্যে আসা অর্ধেকের চেয়ে বেশি শ্রমিক কাজ না পেয়ে ফিরে যান। অন্যদিকে নাগালের বাইরে জিনিসপত্রের দাম। পরিবার–পরিজন নিয়ে অনেক কষ্টের মধ্যে আছেন তাঁরা।
আবদুল মিয়া নামের এক শ্রমিক প্রথম আলোকে বলেন, ‘কিতা আর কইমু, জিনিসপত্রের দাম অতিরিক্ত। আমরা গরিব মানুষ। গরিব বাঁচত কিলা। ৫০০ টাকা লইয়া বাজারে আইলে কুনতা অয় না (কিচ্ছু হয় না)। গরিবের লাগি বিপদ আইছে।’
হবিগঞ্জের চুনারুঘাটের কাসেম মিয়া বলেন, ‘১২ দিন অইছে এখানে (মৌলভীবাজার) আইছি। এর মধ্যে ৩ দিন কাম করছি, ৯ দিনই বওয়াত (বসে আছি)। এই পরিস্থিতি অইলে কেমনে বাঁচমু। খুব বেশি কষ্ট অই যায়।’ মবশ্বির মিয়া জানালেন, অন্য বছর এই সময়ে ঢালাই, মাটি কাটাসহ বিভিন্ন ধরনের প্রচুর কাজ মিলেছে। এক দিনও বসে থাকতে হয়নি। এবার কাজ নেই। এক দিন কাজ করলে সাধারণত ৭০০ টাকা মেলে। এর নিচে কেউ কাজে যান না। কিন্তু এখন পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। ৫৫০ থেকে ৬০০ টাকার বেশি কেউ রোজ দিতে চান না।
মবশ্বির মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘যারা কাজও নিত, আয় তারার সোজা কথা পোষাইলে আও, না পোষাইলে নাই।’ মবশ্বির মিয়ার সঙ্গে কথা বলার সময় দুই-তিনজন শ্রমিক কাজে গেলেন। জানা গেল, তাঁরা ৬০০ টাকা রোজেই কাজে যাচ্ছে।
মৌলভীবাজার শহরের চৌমোহনা চত্বর একটি ভ্রাম্যমাণ শ্রমিকের হাট। প্রতিদিন সকালে শহর, শহরতলির নানা প্রান্ত থেকে কয়েক শ শ্রমিক এখানে এসে জড়ো হন। সকাল ছয়টার দিক থেকে এই চত্বরে শ্রমিকদের আসা শুরু হয়। সকাল আটটা-নয়টা পর্যন্ত অনেকে আসেন। নির্মাণকাজসহ বিভিন্ন ধরনের কাজে এখান থেকে লোকজন শ্রমিকদের নিয়ে যান। সকালে শহরের অন্য স্থানগুলো নিরিবিলি থাকলেও চৌমোহনা চত্বরটি নানা বয়সের শ্রমিকে সরগরম হয়ে ওঠে। প্রতিদিনই ভ্রাম্যমাণ দুই–তিনটি চা ও শরবতের দোকান বসে। শ্রমিকেরা এই দোকানগুলো থেকে চা-পান করেন।
আখলিছ মিয়া নামের এক শ্রমিক প্রথম আলোকে বলেন, ‘চাইর দিন ধরি আরাম (আসছি) আর যারাম (যাচ্ছি)। একটা কামও নাই। দেখরা নানি (দেখছেন না) সব বই রইছে (বসে আছে)। মানুষের খুব অভাবও। একবেলা খাইলে চাইরবেলা উপাস। আমরার তো কামর ওপরই নির্ভরতা।’
ঘণ্টাখানেক চৌমোহনা চত্বরে অবস্থানের সময় শ্রমিকের সংখ্যা আরও অনেক বেড়েছে। রোদ ক্রমে তেতে উঠেছে, কিন্তু শ্রমিকদের কাজে যেতে তেমন একটা দেখা যায়নি। এদিক-ওদিক থেকে কিছু লোক আসছেন, এক-দুজনকে সঙ্গে নিয়ে চলে যাচ্ছেন। হঠাৎ করে চার-পাঁচজনের কোনো দলকে সিএনজিচালিত টমটমে দূরে কোথাও নিয়ে যেতে দেখা গেছে। তবে তাতে শ্রমিকের ভিড় খুব একটা কমেনি। কেউ দাঁড়িয়ে, কেউ পায়চারি করে, আবার কেউ বসেই তখনো সময় পার করছেন।