উপকূলীয় জনপদে তরুণদের রক্তের বন্ধন
মুমূর্ষু রোগীর জন্য রক্তের প্রয়োজন, এমন খবর পেলেই ছুটে যান তাঁরা। ঠিকানা নিয়ে পৌঁছে যান রোগীর হাসপাতালে। রক্ত দিয়ে ফেরেন হাসিমুখে। খুলনার সুন্দরবনসংলগ্ন উপকূলীয় কয়রা উপজেলার একদল তরুণ এভাবেই স্বেচ্ছায় রক্ত দেন। আবার প্রয়োজনীয় রক্ত রোগী ও স্বজনদের ব্যবস্থা করে দেন। এই তরুণেরা স্বেচ্ছায় রক্তদাতার সংগঠন ‘কয়রা ব্লাড ব্যাংক’ তৈরি করেছেন। স্বেচ্ছায় রক্ত দিয়ে তাঁরা সাধারণ মানুষের সঙ্গে যেন তৈরি করেছেন রক্তের বন্ধন।
আজ ১৪ জুন বিশ্ব রক্তদাতা দিবস। এ উপলক্ষে আজ সকালে সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমানের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, প্রায় প্রতিদিনই এলাকার অনেক অসুস্থ রোগীর রক্তের প্রয়োজন হয়। তাঁর বন্ধু সোহাগ বাবু, নূরে আলমসহ কয়েকজন মিলে এ বিষয়ে কিছু করার উদ্যোগ নেন। পরে তাঁরা ২০১৮ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি প্রতিষ্ঠা করেন কয়রা ব্লাড ব্যাংক। বর্তমানে পাঁচ হাজার তরুণ রক্তদাতা সদস্য তালিকাভুক্ত রয়েছেন। তাঁদের মধ্য থেকে ৩৩ সদস্যবিশিষ্ট নির্বাহী কমিটি সংগঠনের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। রক্তদাতারা বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করেন।
মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘আমাদের সংগঠনটি গঠন করার আগে এলাকার কারও রক্তের প্রয়োজন হলে প্রয়োজনীয় রক্তের গ্রুপ জেনে মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিতাম। তবুও মানুষ তেমন সাড়া দিত না। আর এখন কয়রা ব্লাড ব্যাংক সংগঠনটি সুন্দরবন উপকূলীয় জনপদের মানুষের ভরসার জায়গা হয়ে উঠেছে।’
কয়রা উপজেলার গোবরা গ্রামের ১৩ বছরের শিশু মনোয়ার হোসেনের ৯ বছর বয়সে থ্যালাসেমিয়া ধরা পড়ে। চার বছর ধরে প্রতি মাসে মনোয়ারকে এক ব্যাগ রক্ত দিতে হয়। মনোয়ারের জন্য নিয়মিত রক্তদাতা জোগাড় করে দেয় কয়রা ব্লাড ব্যাংক। মনোয়ার হোসেনের মা মুর্শিদা বেগম বলেন, ‘আমার ছেলের বাবা বেঁচে নেই। ছেলের থ্যালাসেমিয়া ধরা পড়ার পর রক্ত জোগাড় করা কঠিন হয়ে গিয়েছিল। আত্মীয়স্বজনের মধ্যে যোগাযোগ করেও রক্তের ব্যবস্থা হচ্ছিল না। পরে কয়রা ব্লাড ব্যাংক সংগঠনটির কথা জানতে পেরে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করি। এর পর থেকে আমাকে আর রক্তের চিন্তা করতে হয়নি। ব্লাড ব্যাংকের ভাইয়েরা আমার যে উপকার করছেন, তা আমি জীবনেও ভুলব না।’
এ পর্যন্ত আমি ১৮ বার রক্ত দিয়েছি। রক্ত দিয়ে মানুষের জীবন বাঁচানো আমাদের কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। আমার এক ব্যাগ রক্তে যদি কোনো মানুষের উপকার হয়, তাহলে ক্ষতি কী?
গত বুধবার কয়রার একটি বেসরকারি ক্লিনিকে মনোয়ার হোসেনকে রক্ত দিয়েছেন কয়রা ব্লাড ব্যাংকের সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুল আলিম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ পর্যন্ত আমি ১৮ বার রক্ত দিয়েছি। রক্ত দিয়ে মানুষের জীবন বাঁচানো আমাদের কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। আমার এক ব্যাগ রক্তে যদি কোনো মানুষের উপকার হয়, তাহলে ক্ষতি কী? রক্ত দেওয়ার পর মনোয়ারের মায়ের হাসিমাখা মুখ দেখে যে প্রশান্তি পেয়েছি, লাখ টাকা দিলেও ওই সুখ পেতাম না।’
কয়রা ব্লাড ব্যাংকের নির্বাহী কমিটির সাধারণ সম্পাদক নায়মুল হুদা (রনি) বলেন, তাঁদের কাছে যে কেউ রক্ত চাইলে রোগীর ঠিকানা, হাসপাতাল বা ক্লিনিকের নাম জেনে নেন। এরপর ওই এলাকায় থাকা স্বেচ্ছায় রক্তদাতা সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রয়োজনীয় রক্তের ব্যবস্থা করে দেন। ২০২১ সাল থেকে রক্তদানের হিসাব তাঁরা লিখে রেখেছেন। সে হিসাবে তিন বছরে স্বেচ্ছায় ২ হাজার ৭১ ব্যাগ রক্ত দান করেছেন সংগঠনের সদস্যরা। চলতি বছরের পাঁচ মাসে এরই মধ্যে ৩২২ ব্যাগ রক্তদান সম্পন্ন হয়েছে।
কয়রা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা রেজাউল করিম বলেন, শরীরের লোহিত রক্তকণিকার আয়ুষ্কাল সর্বোচ্চ ১২০ দিন। তাই কেউ যদি রক্তদান না–ও করেন, তাহলে সেই রক্তকণিকা ১২০ দিন পর নষ্ট হয়ে শরীরের অন্যান্য উপাদানের সঙ্গে মিশে যায়। তাই সুস্থ মানুষের চার মাস পরপর রক্তদানে কোনো ক্ষতি নেই। আর কয়রার তরুণদের রক্তদানের উদ্যোগ এখন সুন্দরবন উপকূলীয় জনপদে দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওই তরুণেরা রাতদিন, ঝড়বৃষ্টি উপেক্ষা করে মানুষের পাশে যান, রক্ত দেন। তাঁরা সত্যিকারের মানবপ্রেমী।