ইন্টারনেট ব্যবহার করে গ্রামের নারীরাও স্বাবলম্বী হচ্ছেন

শরীয়তপুরের ৬টি উপজেলার ৪০টি ইউনিয়নে অনুষ্ঠিত হয়েছে উঠান বৈঠক। জেলাটির গোসাইরহাট উপজেলার চর সাতমাটিয়ার উঠান বৈঠকের একটি চিত্রছবি: প্রথম আলো

বিশিষ্ট সমাজ সংস্কারক ও ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের নেতা হাজী শরীয়ত উল্লাহর নামানুসারে জেলা শরীয়তপুর। বাসিন্দাদের অধিকাংশই কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত। এখানে উৎপাদনশীল শস্যের মধ্যে রয়েছে ধান, পাট, গম, পেঁয়াজ, মিষ্টি আলু, টমেটো প্রভৃতি। ১৯৮৪ সালের আগপর্যন্ত একটি মহকুমা হিসেবেই ছিল শরীয়তপুর। এই জেলারই গোসাইরহাট উপজেলার অজপাড়াগাঁ চরসাতমাটিয়া। গ্রামের অধিকাংশ মানুষ কৃষিকাজ এবং নদী-খালে মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করেন।

গ্রামটির গৃহিণী মনি আক্তার (২৮)। তাঁর স্বামী ফারুক দেওয়ান কৃষিশ্রমিকের কাজের পাশাপাশি মাংস প্রক্রিয়ার কাজ করেন। স্বামীর আয়ে সংসার চলছিল না। ছেলের পড়ালেখা, শ্বশুর-শাশুড়ির অসুস্থতা ইত্যাদি খরচ বহন করতে হিমশিম খেতে হচ্ছিল মনি আক্তারের। চার বছর আগে তিনি ইন্টারনেট ঘেঁটে সেলাইয়ের কাজ শেখেন। এরপর একটি সেলাই মেশিন কিনে বাড়িতে বসেই মেয়ে ও শিশুদের পোশাক তৈরির কাজ শুরু করেন। এতে প্রতি মাসে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা আয় হয় তাঁর। এখন ছেলের পড়ালেখার খরচ নিজেই চালাচ্ছেন মনি। সংসারেও ফিরেছে সচ্ছলতা।

গ্রামীণফোনের উদ্যোগে সারা দেশে চলছে ‘ইন্টারনেটের দুনিয়া সবার’ শীর্ষক উঠান বৈঠক। ৭ ডিসেম্বর নিজ এলাকায় আয়োজিত উঠান বৈঠকে সংসারের সচ্ছলতা ফেরানোর গল্প বলছিলেন মনি আক্তার। তিনি বলেন, ‘আমাদের এলাকায় ইন্টারনেটের ব্যবহার অনেক আগে শুরু হলেও দারিদ্র্যতার কারণে তা হাতের নাগালে পাওয়ার সুযোগ ছিল না। আমার এক আত্মীয়র মাধ্যমে জেনেছি ইন্টারনেটে অনেক কিছু শেখা যায়। তখনই সেলাই করা ও মেয়েদের পোশাক তৈরি শেখার প্রতি আগ্রহী হই। টাকা জমিয়ে একটি স্মার্টফোন কিনে ইন্টারনেটে ভিডিও দেখে পোশাক তৈরি শিখি। এখন সংসারের কাজের ফাঁকে ও অবসরে ঘরে বসেই প্রতি মাসে গড়ে ১৩ থেকে ১৫ হাজার টাকা আয় করতে পারছি। চার বছরেই সংসারের অভাব ঘোচাতে পেরে আমি খুব খুশি।’

সারা দেশে দুই হাজারের বেশি ইউনিয়নে প্রান্তিক নারীদের নিয়ে গ্রামীণফোনের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হচ্ছে উঠান বৈঠক। এসব আয়োজনে স্থানীয়ভাবে সহযোগিতা করছেন প্রথম আলো বন্ধুসভার সদস্যরা। ৭ ডিসেম্বর শরীয়তপুরের গোসাইরহাট ও সামন্তসার ইউনিয়নের দুটি গ্রামে এমন উঠান বৈঠকে দেড় শতাধিক নারী অংশ নেন। ওই দুটি উঠান বৈঠকে উপস্থাপনা করেছেন শরীয়তপুর বন্ধুসভার সদস্য সানজিদা সুইটি। তাঁকে সহযোগিতা করেছেন বন্ধুসভার সাধারণ সম্পাদক তাদমিম হোসেন, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সালাউদ্দিন রুপম ও সদস্য সামিয়া আফরিন। ১৬ নভেম্বর থেকে শুরু হয়ে ৮ ডিসেম্বর শরীয়তপুরে ৪০টি উঠান বৈঠক সম্পন্ন হয়েছে।

ইন্টারনেটের বহুমুখী ব্যবহার শেখাতে সারা দেশের দুই হাজারের বেশি ইউনিয়নে চলছে ‘ইন্টারনেটের দুনিয়া সবার’ শীর্ষক আয়োজন।

উঠান বেঠকে ইন্টারনেটে ইউটিউব ব্যবহার, কৃষিপণ্য ব্যবস্থাপনা, চাষাবাদ, স্বাস্থ্যসেবা তথ্য, শিশুর স্বাস্থ্য পরিচর্যা, কাগজ দিয়ে নানা উপকরণ তৈরি ও ইন্টারনেট প্যাকেজ ক্রয়বিষয়ক নানা ভিডিও দেখানো হয়। প্রায় এক ঘণ্টার এই বৈঠকে অংশগ্রহণকারী সব নারীই ছিলেন ভীষণ মনোযোগী।

তেমনই একজন চর সামন্তসার গ্রামের গৃহিণী সাবিকুন নাহার। অল্প বয়সে বিয়ে হয় নাহারের। স্বামী কৃষিকাজ করেন। সংসারের অভাব থাকায় তিনি হাঁস-মুরগির খামার গড়ে তোলেন। এখন ওই খামার থেকে তাঁর বছরে অন্তত ২ লাখ টাকা আয় হয়। সাবিকুন নাহার বলেন, ‘হাঁস-মুরগির খামারটি গড়ে তুলতে আগ্রহী হয়েছিলাম ইউটিউবে ভিডিও দেখে। ভিডিও দেখেই খামার করার অনেক ধারণা ও প্রশিক্ষণ নিয়েছি। হাঁস–মুরগির পরিচর্যা, চিকিৎসা ও খাদ্য দেওয়া সবই ইন্টারনেট দেখে করছি। ইন্টারনেটের এত শক্তি, এভাবে মানুষের জীবন বদলে দিতে পারে, তা নিজে এ পর্যায়ে আসার আগে কখনোই ভাবিনি।’

মানুষের নানা দৈনন্দিন চাহিদা ও প্রয়োজন মেটাতে ইন্টারনেট যে সক্ষম, সে বিষয়টি তৃণমূলের নারীদের সরাসরি শেখাতেই ‘ইন্টারনেট দুনিয়া সবার’ উদ্যোগ। সহযোগিতায় রয়েছে প্রথম আলো, নকিয়া ও ঢাকা ব্যাংক পিএলসি। ২০২৩ সালের মার্চে শুরু হওয়া কার্যক্রমটির আওতায় গতকাল রোববার (২৯ ডিসেম্বর) পর্যন্ত ২ হাজার ৪৯টি ইউনিয়নে উঠান বৈঠক সম্পন্ন হয়েছে।