সোনা চোরাচালানে ধরা পড়েন শুধু বাহকেরা, আড়ালে রয়ে যান ‘বড়রা’
ঝিনাইদহ, যশোর ও চুয়াডাঙ্গা দিয়ে সোনা চোরাচালান বেশি হয়। সংসদ সদস্য খুনের পর বিষয়টি আলোচনায় এসেছে।
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের তিন জেলা ঝিনাইদহ, যশোর ও চুয়াডাঙ্গার ভারতীয় সীমান্ত এলাকা দীর্ঘদিন ধরে সোনা চোরাচালানের অন্যতম পথ বা রুট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। জেলাগুলোতে ভারতে পাচারের সময় প্রায়ই সোনার বড় বড় চালান ধরা পড়ে। তবে আটক হন শুধু সোনা বহনকারী বেকার তরুণ, ভ্যান-রিকশাচালক ও গ্রামের মানুষেরা। মামলার রায় হলে সাজাও হয় শুধু তাঁদের। কিন্তু চোরাচালানের মূল হোতাদের খুঁজে বের করতে পারে না পুলিশ।
তিন জেলার সীমান্তে দায়িত্বরত বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও সংশ্লিষ্ট থানা-পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, এক বছরে তিন জেলার সীমান্তে অন্তত ১৩০ কেজি সোনা জব্দ করা হয়েছে, যার বাজারমূল্য প্রায় ১২৮ কোটি টাকা। এসব ঘটনায় মামলা হয়েছে ৫৩টি। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, যে পরিমাণ সোনা ধরা পড়ছে, চোরাচালান হচ্ছে তার চেয়ে অনেক বেশি।
যারা সোনা বহনকারী, তারা ওপর বা নিচের কাউকে তেমন চেনে না। যে কারণে তাদের কাছ থেকেও সেভাবে তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায় না। ফলে মূল অপরাধী পর্যন্ত সব সময় পৌঁছানো যায় না।সুমন ভক্ত, ওসি, বেনাপোল থানা
ভারতের কলকাতায় ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম খুনের ঘটনায় নতুন করে সামনে এসেছে সীমান্তকেন্দ্রিক সোনা চোরাচালানের বিষয়টি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং সীমান্তকেন্দ্রিক তৎপরতার বিষয়ে ওয়াকিবহাল একাধিক সূত্র বলছে, আনোয়ারুল আজীম খুনের নেপথ্যে সোনা চোরাচালানকেন্দ্রিক বিরোধ। এই খুনের মূল পরিকল্পনাকারী আনোয়ারুলের বন্ধু আক্তারুজ্জামান ওরফে শাহীন, যিনি সোনা পাচারকারী একটি চক্রের প্রধান। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে কোনো মামলা নেই।
সোনা ও অন্যান্য পণ্য আটকের ঘটনায় বিজিবি থানায় মামলা করে। তদন্ত করে পুলিশ। সোনা চোরাচালানের মামলার তদন্ত করে মূল হোতাদের বের করার দায়িত্ব পুলিশের বলে মনে করেন বিজিবির খালিশপুর ৫৮ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল আজিজুস শহীদ।
অবশ্য যশোর পুলিশের মুখপাত্র ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) বেলাল হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত, তাদেরই আসামি করা হয়। মূল হোতাদের নাম না আসার বিষয়ে তিনি বলেন, বাহকের পাশাপাশি অন্যরাও আসামি হয়। তথ্য-প্রমাণ না পেলে তো কাউকে আসামি করা যায় না।
বাংলাদেশ পথ: তিন জেলা দিয়ে বেশি
চোরাচালানের মাধ্যমে ভারতে প্রতিবছর প্রচুর সোনা যায়। একটি পথ হলো বাংলাদেশ। ২০২৩ সালের ২৩ এপ্রিল ভারতের ইকোনমিক টাইমস-এর এক বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২১-২২ অর্থবছরে ভারতের ডিপার্টমেন্ট অব রেভিনিউ ইন্টেলিজেন্স (ডিআরআই) মোট ৮৩৩ কেজি সোনা জব্দ করে। ওই প্রতিবেদনে ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের বরাত দিয়ে বলা হয়, দেশটিতে বছরে আট লাখ কেজি সোনার চাহিদা রয়েছে। বছরে ৮০ থেকে ৯০ হাজার কেজি সোনা চোরাচালানের মাধ্যমে ঢোকে।
ইকোনমিক টাইমস-এর প্রতিবেদন আরও বলছে, ভারতে সোনার ওপর শুল্ক-কর মোট সাড়ে ১৮ শতাংশ। এতে চোরাচালান উৎসাহিত হয়। চোরাচালানের মাধ্যমে ঢোকা প্রতি কেজি সোনার দাম ৮ থেকে ৯ লাখ রুপি (১১-১৩ লাখ টাকা) কম পড়ে। ওই সময় ভারতের মুম্বাইয়ে সোনার দাম ছিল প্রতি কেজি প্রায় ৬১ লাখ রুপি (৮৬ লাখ টাকা)।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা মনে করেন, মধ্যপ্রাচ্য, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়া থেকে বাংলাদেশের বিমানবন্দর দিয়ে অবৈধভাবে সোনা আনা হয়। তারপর তা সীমান্ত দিয়ে ভারতে পাঠানো হয়। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মাধ্যমে ভারতে সোনা চোরাচালান বেশি হয়। দুই দেশকে বেছে নেওয়ার কারণ, নিরাপত্তার দুর্বলতা।
বাংলাদেশ বর্ডার গার্ডের (বিজিবি) হিসাবে, তারা ২০২৩ সালে সীমান্ত এলাকা থেকে প্রায় ২৬১ কেজি সোনা জব্দ করেছে। এদিকে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে বিজিবি ও পুলিশের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে দেখা যায়, ঝিনাইদহ, যশোর ও চুয়াডাঙ্গায় ২০২৩ সালে ১৩০ কেজি সোনা জব্দ করা হয়েছে। উল্লেখ্য, চুয়াডাঙ্গার হিসাবটি ২০২৩ সালের ১৬ জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের ৮ মার্চ পর্যন্ত।
২৭১ কিলোমিটারের সীমান্ত
ঝিনাইদহ, যশোর ও চুয়াডাঙ্গা জেলার সঙ্গে ভারতের সীমান্ত রয়েছে ২৭১ কিলোমিটারের। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গাড়ির ভেতরে বিশেষ কায়দায় লুকিয়ে, পেটের ভেতর বা পায়ুপথে, শরীরে বেঁধে, স্যান্ডেল বা জুতার সোলের ভেতরে রেখে ইত্যাদি নানা কৌশলে সোনা পাচার হয়।
ভারতের সঙ্গে চুয়াডাঙ্গার প্রায় ১১৩ কিলোমিটার সীমান্তে চুয়াডাঙ্গা ব্যাটালিয়ন (৬ বিজিবি) ও ঝিনাইদহের মহেশপুর ব্যাটালিয়ন (৫৮ বিজিবি) দায়িত্ব পালন করে। বিজিবি ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ১৬ জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের ৮ মার্চ পর্যন্ত বিজিবি ও ডিবি পুলিশ দর্শনা, জীবননগর ও দামুড়হুদা সীমান্তে অন্তত ৩০টি অভিযানে ৬৪ কেজি ৮৪৮ গ্রাম সোনা উদ্ধার করে।
২০২৩ সালে ঝিনাইদহের মহেশপুর সীমান্ত এলাকা থেকে ৩৮ কেজি সোনা আটক করে বিজিবি। ওই উপজেলার সঙ্গে ভারতের প্রায় ৫৭ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে।
যশোরের শার্শা, বেনাপোল ও চৌগাছা সীমান্ত এলাকায় দায়িত্ব পালন করে যশোর ব্যাটালিয়ন (৪৯ বিজিবি) ও খুলনা ব্যাটালিয়ন (২১ বিজিবি)। যশোর ব্যাটালিয়ন সূত্রে জানা গেছে, এই সীমান্তে ২০২৩ সালে সাড়ে ২৭ কেজি সোনা উদ্ধার করা হয়েছে। যশোরে সীমান্ত এলাকা ১০১ কিলোমিটার।
সম্প্রতি বিজিবির মহেশপুর ব্যাটালিয়নের (৫৮ বিজিবি) অধিনায়কের দায়িত্বে এসেছেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল এইচ এম সালাহউদ্দিন চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্বর্ণ পাচার পুরোপুরি বন্ধ হয়েছে, তা নিশ্চিত করে বলতে পারব না। তবে আমার যোগদানের পর সোনা উদ্ধারের কোনো ঘটনা নেই। বিজিবি সতর্কতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছে।’
ধরা পড়েন শুধু বাহকেরা
তিন জেলার সীমান্তে সোনার চালান আটক হওয়ার বিভিন্ন ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বিজিবি ও পুলিশ সোনা বহনকারীকে ধরতে পেরেছে। পরে অধিকতর তদন্ত করে চোরাচালানকারী মূল ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারের কথা; তবে তা সম্ভব হয়নি।
যেমন ২০২২ সালের ১৬ নভেম্বর যশোরের বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে একটি পিকআপে করে সাড়ে ১৬ কেজি ওজনের ১১২টি সোনার বার ভারতে পাচারের সময় মো. ওমর ফারুক (২৭) ও মো. ফরহাদ সরকার (৩২) নামের দুই ব্যক্তিকে আটক করে বিজিবি। এ ঘটনায় তিন বাহককে আসামি করে বেনাপোল বন্দর থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা হয়। তদন্ত শেষে ওই মামলার অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করে বেনাপোল বন্দর থানা-পুলিশ। মামলায় বাহকদের আসামি করা হয়েছে। চোরাচালানের মূল হোতারা থেকে গেছেন তদন্তের বাইরে।
বিষয়টি নিয়ে বেনাপোল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সুমন ভক্ত প্রথম আলোকে বলেন, সাধারণত সোনা চোরাচালান খুব কৌশলে হয়। যারা সোনা বহনকারী, তারা ওপর বা নিচের কাউকে তেমন চেনে না। যে কারণে তাদের কাছ থেকেও সেভাবে তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায় না। ফলে মূল অপরাধী পর্যন্ত সব সময় পৌঁছানো যায় না।
শাস্তিও হয় শুধু বাহকদের
চুয়াডাঙ্গা সীমান্তে সোনা চোরাচালানের ঘটনায় ২০১৭ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত মামলাগুলোর মধ্যে ২১টির অভিযোগপত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ১৯টি অভিযানের ঘটনায় এজাহারভুক্ত আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। দুটি মামলায় আসামি অজ্ঞাতনামা হওয়ায় আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। কোনো মামলার তদন্তেই ঘটনার পেছনে কারা জড়িত বা সোনার উৎস বিষয়ে কোনো তথ্য উদ্ঘাটনের নজির নেই। তবে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়া আসামিদের ন্যূনতম যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন আদালত।
রায় হওয়া ছয়টি মামলার তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, শাস্তি পেয়েছেন শুধু বাহকেরা। যেমন ২০১৭ সালের ১৪ এপ্রিল বিজিবি দামুড়হুদার পারকৃষ্ণপুর থেকে পার্শ্ববর্তী ঝাঁঝাডাঙ্গা গ্রামের শিপন রানাকে ৩ কেজি ১৭৫ গ্রাম সোনার বারসহ আটক করে। দামুড়হুদা মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) জি এম ইমদাদুল হক একই বছরের ৩১ অক্টোবর শিপন রানার বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। চুয়াডাঙ্গার স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল-১-এর বিচারক জেলা ও দায়রা জজ মোহা. রবিউল ইসলাম ২০২০ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি শিপনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন।
এই ঘটনায় সোনার মালিক কে, বহনকারীকে কারা সোনা দিয়েছিল, তা তদন্ত করে বের করতে পারেনি পুলিশ। চুয়াডাঙ্গা আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) মো. বেলাল হোসেন সম্প্রতি পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেসি সভায় সোনা চোরাচালানের মামলার প্রসঙ্গ তোলেন। তিনি বলেন, তদন্তে সোনার উৎস এবং এর মহাজনের বিষয়টি অস্পষ্টই থেকে যাচ্ছে। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট সবাইকে আন্তরিকতার সঙ্গে দেখার আহ্বান জানান তিনি।
‘তাঁরা আড়ালেই থাকেন’
সীমান্ত দিয়ে যুগ যুগ ধরে চলছে চোরাচালান। মহেশপুরের বাঘাডাঙ্গা সীমান্তের এক সাবেক ইউপি সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, আশির দশকে ভিসিপি-ভিসিআর (ভিডিও দেখার ইলেকট্রনিক যন্ত্র) নিয়ে যাওয়া হতো ভারতে, আর সেখান থেকে নিয়ে আসা হতো মাদক ও শাড়ি। এরপর শুরু হয় সোনা চোরাচালান। চোরাচালানিতে বাহকের ভূমিকা পালন করে সীমান্তের গ্রামগুলোর অনেকে অর্থবিত্তের মালিক হচ্ছেন।
সংসদ সদস্য আনোয়ারুলকে খুনের পর এখন সোনা চোরাচালান চক্রের হোতাদের সম্পদ, বিলাসী জীবন ও অর্থ পাচারের বিষয়টি সামনে আসছে। ঝিনাইদহের মহেশপুরের একজন স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধি নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, চোরাচালানের সঙ্গে প্রভাবশালীরা জড়িত। অনেক জনপ্রতিনিধিও চোরাচালানের মাধ্যমে টাকা করেছেন। তাঁরা আড়ালেই থাকেন, কখনো ধরা পড়েন না।