মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার বাসাই গ্রামের বিশেষায়িত বিদ্যালয় ব্লুমস (বিকনিং লাইট অর্গানাইজেশন অব ম্যানকাইন্ড অ্যান্ড সোসাইটি) সমাজের বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু-কিশোরদের বিনা মূল্যে পড়ালেখা, চিকিৎসাসেবা ও প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছে। ইতিমধ্যে এই বিদ্যালয়ের শিশু-কিশোরদের অনেকে এখন মূলধারায় ফিরেছে।
তবে আর্থিক সংকটসহ নানা সীমাবদ্ধতায় বিদ্যালয়টির কার্যক্রম চালানো এখন কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে।
ব্লুমস নামের বিশেষায়িত এই বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন ২০১৬ সালে গুলশানের হোলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় জঙ্গিদের ছোড়া গুলিতে নিহত ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) তৎকালীন সহকারী কমিশনার রবিউল করিম।
বিদ্যালয়টিতে চারজন শিক্ষক ও চারজন কর্মচারী রয়েছেন। আর্থিক সংকটে শিক্ষকদের বেতন দেওয়া যাচ্ছে না।
বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও প্রতিষ্ঠাতার পরিবার সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার আটিগ্রাম ইউনিয়নের কাটিগ্রাম গ্রামে রবিউল করিমের বাড়ি। সমাজের পিছিয়ে পড়া বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু-কিশোরদের জন্য বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ইচ্ছা ছিল রবিউলের বাবা আবদুল মালেকের। ২০০৬ সালে আবদুল মালেকের মৃত্যুর পর তাঁর ইচ্ছা পূরণের স্বপ্ন দেখেন রবিউল। কিন্তু বিদ্যালয় গড়তে তো জমি ও অর্থের প্রয়োজন। স্বামীর ইচ্ছা এবং ছেলের স্বপ্ন পূরণে এগিয়ে এলেন মা করিমন নেছা। তিনি নিজের ২৯ শতক জমি দান করলেন। ২০১১ সালে বাড়ির অদূরে বাসাই গ্রামে মায়ের দান করা সেই জমিতে রবিউল প্রতিষ্ঠা করেন ব্লুমস। ২০১২ সালে ১২টি অটিস্টিক শিশু-কিশোরকে নিয়ে বিদ্যালয়টির কার্যক্রম শুরু হয়।
বর্তমানে বিদ্যালয়টিতে ৪৬ শিশু-কিশোর পড়াশোনা ও চিকিৎসাসেবা নিচ্ছে। এই শিশু-কিশোরেরা অটিজম, শ্রবণ, বাক্ ও শারীরিক সক্ষমতাহীন এবং সেরিব্রাল পালসে আক্রান্ত। বিশেষায়িত এই বিদ্যালয়ে সপ্তাহে পাঁচ দিন পাঠদান করানো হয়। শিশু-কিশোরদের ফিজিওথেরাপি ও স্পিচ থেরাপি দেওয়ার পাশাপাশি ইশারা ভাষা শেখানো হয়। আছে খেলাধুলার ব্যবস্থাও।
বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা জানান, প্রায় সাত বছর ধরে বিদ্যালয়ের শিশু-কিশোরদের জন্য দুপুরের খাবার (ডে-মিল) দেওয়া হয়। বিদ্যালয়ের নিজস্ব ব্যাটারিচালিত দুটি ইজিবাইকে করে শিক্ষার্থীদের বাড়ি থেকে বিদ্যালয়ে আনা–নেওয়া করা হয়। পোশাক থেকে শুরু করে স্কুলব্যাগ, বই–খাতাসহ বিভিন্ন শিক্ষা উপকরণ দেওয়া হয়। এ ছাড়া প্রতিবছর মেডিকেল ক্যাম্পের আয়োজন করে শিক্ষার্থীদের চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়।
রবিউল করিম জীবিত থাকা অবস্থায় তাঁর নিজের ও বন্ধুবান্ধবের সহায়তায় বিদ্যালয়টির এসব কার্যকম চলত। রবিউলের মৃত্যুর পর আর্থিক সংকটে বিদ্যালয়টির কার্যক্রম চালানো কষ্টকর হয়ে পড়েছে।
এ ব্যাপারে বিদ্যালয়টির পরিচালক (প্রশাসন) সাংবাদিক নূর সিদ্দিকী বলেন, অর্থের অভাবে নানা সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বিদ্যালয়টি। ফিজিওথেরাপি ও স্পিচ থেরাপির জন্য আলাদা দুটি কক্ষ প্রয়োজন। ফিজিওথেরাপির জন্য বিশেষ ধরনের বিছানাও (শয্যা) দরকার। স্পিচ থেরাপির জন্য প্রয়োজনীয় কিছু সামগ্রীও জরুরি। এ ছাড়া বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু-কিশোরদের চিকিৎসা বা থেরাপির জন্য বিশেষ ধরনের খেলনা লাগে। অর্থসংকটে এসব কেনা সম্ভব হচ্ছে না। অর্থাভাবে শিশুদের দুপুরের খাওয়ার ব্যবস্থা করাও কষ্টকর হয়ে পড়েছে।
অর্থাভাবে শিক্ষকদের বেতন দেওয়া যাচ্ছে না জানিয়ে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, বিদ্যালয়টিতে চারজন শিক্ষক ও চারজন কর্মচারী রয়েছেন। আর্থিক সংকটে শিক্ষকদের বেতন দেওয়া যাচ্ছে না। বিদ্যালয়ের সীমানাপ্রাচীর নেই। শিক্ষার্থীদের আনা–নেওয়ার জন্য দুটির জায়গায় চারটি ইজিবাইক প্রয়োজন। কিন্তু অর্থাভাবে তা কেনা যাচ্ছে না। সমাজের পিছিয়ে পড়া বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন এসব শিশুদের পাশে দাঁড়াতে সমাজের বিত্তবান ব্যক্তিদের সহায়তার আহ্বান জানান তিনি।
বিদ্যালয়টির পরিচালনা কমিটির সদস্যসচিব রবিউল করিমের ছোট ভাই প্রথম আলোর সাভারের নিজস্ব প্রতিবেদক শামসুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘রবিউল ভাইয়ের মৃত্যুর পর ব্লুমস ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠান থেকে সর্বজনীন প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। দরিদ্র ও অসহায় বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের কল্যাণে এ প্রতিষ্ঠানকে টিকিয়ে রাখতে সবার সহযোগিতা প্রয়োজন। কিছু মানবিক মানুষের আর্থিক সহযোগিতার মধ্য দিয়ে বর্তমানে কোনোরকমে প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়া হচ্ছে। আমরা এই শিশুদের জন্য আরও ভালো কিছু করতে চাই। এ জন্য আরও মানবিক মানুষেরা আমাদের পাশে দাঁড়াবেন, আশা করি।’