পায়রা নদীর চরে ভেসে এসেছে ৩২ ফুট লম্বা মৃত তিমি
বরগুনায় সংরক্ষিত বনাঞ্চলের চরে একটি তিমির মৃতদেহ পাওয়া গেছে। বরগুনার সদর উপজেলার এম বালিয়াতলী ইউনিয়নের ছোনবুনিয়া এলাকাসংলগ্ন পায়রা নদীর তীরে শ্বাসমূলীয় বনের মধ্যে তিমির মৃতদেহটি গতকাল সোমবার দুপুরে দেখতে পান বনরক্ষীরা।
তিমিটির মুখের অংশ পচে যাওয়ায় এটির মৃত্যু হয়েছে এবং মৃত অবস্থায় এটি এখানে ভেসে এসেছে বলে বনরক্ষীরা ধারণা করছেন। পচন ধরে দুর্গন্ধ ছড়ানোয় আজ মঙ্গলবার বেলা তিনটার দিকে তিমির মৃতদেহটি ওই চরেই মাটিচাপা দিয়েছেন বন বিভাগের কর্মীরা। স্থানীয় বাবুগঞ্জ বিট কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
তিমির মৃতদেহের ছবি দেখে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক, তিমি ও ডলফিন গবেষক এম এ আজিজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছবি দেখে যত দূর মনে হচ্ছে, এটা ব্রাইডস হোয়েল। এই তিমির পেটের দিকটা সাদা, পিঠের দিকটা কালচে বর্ণের হয়। তিনি বলেন, প্রাপ্তবয়স্ক ব্রাইডস হোয়েল সাধারণত ১২ থেকে ১৬ মিটার (৪০ থেকে ৫২ ফুট) লম্বা হয়। এদের শরীর ধূসর ও কালো রঙের মধ্যে পরিবর্তিত হয়। নিচের অংশ তুলনামূলক সাদা হয়। এদের মাথা লম্বা ও সরু হয় এবং মাথার ওপরের দিকে তিনটি খাঁজ দেখা যায়, যা এদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। ব্রাইডস হোয়েল সাধারণত প্লাঙ্কটন, ক্রিল ও ছোট মাছ খায়। এরা পানি গিলে ফিল্টারিং প্রক্রিয়ায় খাদ্য সংগ্রহ করে।
গতকাল দুপুরে বরগুনা সদর উপজেলার বালিয়াতলী ইউনিয়নের ছোনবুনিয়ার চরে অর্ধগলিত মাথাবিহীন তিমির মৃতদেহটি দেখতে পান স্থানীয় জেলেরা। পরে বন বিভাগের লোকজন সেখানে যান।
বরগুনা সদর উপজেলার বন বিভাগের বাবুগঞ্জ বিট কার্যালয় সূত্র জানায়, বনের ছোনবুনিয়া এলাকায় বিশাল এই তিমির মৃতদেহটি পড়ে ছিল। সংবাদ পেয়ে বন বিভাগের কর্মীরা ঘটনাস্থলে ছুটে যান। ৩২ ফুট লম্বা এই তিমির মরদেহ এখানে কয়েক দিন আগেই ভেসে আসে বলে তাঁদের ধারণা। খবর পেয়ে উপজেলা প্রশাসন, পুলিশ, বন বিভাগ, প্রাণিসম্পদ ও মৎস্য বিভাগের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। তবে কীভাবে তিমিটি মারা গেছে, তা জানাতে পারেননি বন বিভাগের কর্মকর্তারা।
ব্রাইডস হোয়েল সাধারণত উষ্ণ ও নাতিশীতোষ্ণ মহাসাগরে বাস করে। এদের সাধারণত উপকূলীয় ও গভীর সমুদ্র—উভয় অঞ্চলে পাওয়া যায়। ব্রাইডস হোয়েল প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক সংস্থাগুলোর আন্তর্জাতিক জোট আইইউসিএনের লালতালিকা (বিপন্ন প্রাণীর তালিকা) ভুক্ত। তবে কিছু অঞ্চলে এদের সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে পরিবেশগত পরিবর্তন ও মানুষের নেতিবাচক কার্যকলাপের কারণে।
গবেষকেরা ধারণা করছেন, সাগরের কোনো অংশে অক্সিজেনের অভাব ও প্রচুর দূষণ দেখা দিয়েছে। এটি তিমির মৃত্যুর কারণ হতে পারে। তা ছাড়া সমুদ্রে বিপুলসংখ্যক প্লাস্টিক ফেলা হয়। খাদ্যের সঙ্গে প্লাস্টিক খেয়ে পাকস্থলীতে জমেও তিমির মৃত্যু হতে পারে। এ ছাড়া সমুদ্রে চলাচলকারী জাহাজের সঙ্গে ধাক্কা লেগেও তিমিটির মৃত্যু হতে পারে। তবে একের পর এক তিমি ও ডলফিনের মৃত্যুর কারণ নিশ্চিত করতে হলে এ নিয়ে গভীর গবেষণা হওয়া দরকার।
উপকূলের পরিবেশ-প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ওয়ার্ল্ডফিশের ইকোফিশ-২ অ্যাকটিভিটির একটি পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ২০২২ সালের ৩ সেপ্টেম্বর কুয়াকাটা সৈকতে একটি মৃত তিমি ভেসে এসেছিল। ৩৫ ফুট দৈর্ঘ্যের তিমিটি বেলিন প্রজাতির বলে ওই সময় গবেষকেরা নিশ্চিত করেছিলেন। এর আগে একই প্রজাতির একটি তিমি ২০১৭ সালে কুয়াকাটা সৈকতে ভেসে এসেছিল। সেটি দৈর্ঘ্যে ছিল ৪৫ ফুট।
এ ছাড়া চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন—এই ৬ মাসে কুয়াকাটা সৈকতে ১১টি মৃত ডলফিন ভেসে আসে। ২০১৮ থেকে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৫৮টি ডলফিন কুয়াকাটায় ভেসে এসেছে।
ওয়ার্ল্ডফিশের ইকোফিশ-২ অ্যাকটিভিটির পটুয়াখালী জেলার সহযোগী গবেষক সাগরিকা স্মৃতি আজ দুপুরে প্রথম আলোকে বলেন, একের পর এক তিমি ও ডলফিনের মৃত্যু বড় দুশ্চিন্তার বিষয়। এসব প্রাণীর মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধানে সরকারি-বেসরকারি গভীর অনুসন্ধান প্রয়োজন। সমুদ্রের বন্ধু প্রাণী ডলফিন ও তিমিকে বাঁচাতে ওয়ার্ল্ডফিশের ইকোফিশ-২ অ্যাকটিভিটির পক্ষ থেকে সাগরে মাছ ধরা জেলেদের সচেতন করতে প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথা উল্লেখ করে সাগরিকা স্মৃতি আরও বলেন, ‘আমরা জেলেদের সচেতন করছি। তবে কেন এসব প্রাণী উদ্বেগজনক সংখ্যায় মারা যাচ্ছে, তার সঠিক কারণ উদ্ঘাটন করা জরুরি।’