৫ আগস্ট আনন্দ মিছিল দেখতে গিয়ে গুলিতে নিহত হন রিকশাচালক মতিউর
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের দিন ৫ আগস্ট ঢাকার মিরপুর এলাকায় আনন্দ মিছিল দেখতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান রিকশাচালক মতিউর রহমান (৫১)। বাবার এমন মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না তাঁর বড় মেয়ে নুরুন্নাহার। অভাবের সংসার এখন কীভাবে চলবে, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন তিনি।
নিহত মতিউর রহমানের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার কমলাকান্তপুর গ্রামে। ঢাকার মিরপুর-২ এলাকায় সরকারি আবাসনে পরিবারের সঙ্গে বসবাস করতেন তিনি।
সম্প্রতি আলাপকালে নুরুন্নাহার বলেন, তাঁর বাবা ঢাকার আগারগাঁওয়ে পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রধান কার্যালয়ে অফিস সহায়ক পদে চাকরি করতেন। তাঁর চাকরি স্থায়ী ছিল না। চাকরি স্থায়ী করার দাবিতে ২০১৯ সালে তাঁর বাবা উচ্চ আদালতে মামলাও করেছিলেন। পরে ২০২২ সালে তাঁর বাবাকে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়। এতে কর্মস্থল থেকে শূন্য হাতে ফেরেন তিনি। পরিবার চালাতে বাধ্য হয়ে বাবা রিকশা চালানো শুরু করেন। তাঁরা তিন ভাইবোন লেখাপড়া করেন। অভাব-অনটনের সংসার তাঁদের। এরই মধ্যে বাবা মারা গিয়ে তাঁরা অথই সাগরে পড়ে গেছেন।
৫ আগস্ট গুলিতে মতিউর রহমান নিহত হওয়ার ঘটনা স্মরণ করে নুরুন্নাহার বলেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনার পতনের দিন ঢাকায় রাস্তায় সর্বস্তরের মানুষ আনন্দ-উল্লাস করছিলেন। টিভিতে সেই দৃশ্য দেখে বাবাও অনেক খুশি হয়েছিলেন। দুপুর পর্যন্ত রিকশা চালিয়ে পাঁচ কেজি চাল কিনে বাড়ি ফিরেছিলেন। দুপুরে খাওয়ার পর টিভিতে খবর দেখছিলেন। সরকারের পতন দেখে বাবা বলেছিলেন, ‘এখন থেকে দেশে ভালো হবে। হয়তো আমার চাকরিটাও ফিরে পেতে পারি। যাই, রাস্তায় মানুষের আনন্দটা দেখে আসি।’ এই বলে বাসা থেকে বেরিয়ে যান বাবা। পরে বিকেলে মিরপুর থানার সামনে গুলিবিদ্ধ হয়ে বাবা লাশ হয়ে ফিরে আসেন। বাবা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী কেউ ছিলেন না। কেবল মানুষের আনন্দ দেখতে বাড়ি থেকে বের হয়েছিলেন।
৫ আগস্ট রাত ১২টার দিকে বাবার লাশ নিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের পথে রওনা হন নুরুন্নাহাররা। ৬ আগস্ট ভোরে তাঁরা যখন রাজশাহীতে পৌঁছান, তখন চাচারা মুঠোফোনে কল করে বলেন, গ্রামের কবরস্থানে বাবার দাফন হবে না। কারণ, বাবা নাকি কবরস্থানের জন্য কোনো চাঁদা দেননি। পরে নানার বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌর এলাকার হরিপুর মহল্লার পূর্বপাড়া কবরস্থানে বাবার লাশ দাফন করা হয় বলে জানালেন নুরুন্নাহার।
কয়েক দিন পরে নুরুন্নাহার ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা পারিবারিক জটিল পরিস্থিতির মুখোমুখি হন। তাঁরা গ্রামের বাড়িতে গেলে চাচারা জানিয়ে দেন, তাঁদের বাড়িতে কোনো ঘরবাড়ি নেই, জমিজমা নেই। তাঁদের বাবা নাকি সব বিক্রি করে দিয়েছেন চাচাদের কাছে। বিক্রির দলিল দেখতে চাইলে তাঁরা দেখাননি।
নুরুন্নাহার বলেন, ঢাকায় সরকারি আবাসনে কত দিন আর থাকতে পারবেন জানেন না। তাঁদের আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। দুই বোন এক ভাই ঢাকায় লেখাপড়া করে। বোন দশম শ্রেণিতে ও ভাই নবম শ্রেণিতে পড়ে। আর তিনি ঢাকায় নার্সিংয়ে স্নাতক শেষ করে ইন্টার্ন করছেন। তাঁর টিউশনি, মায়ের বাড়ি বাড়ি গিয়ে আরবি পড়ানো ও বাবার আয়েই সংসার চলত। বাবা ছাড়া এখন কী হবে বুঝতে পারছেন না।
মুঠোফোনে কথা হয় নিহত মতিউর রহমানের বড় ভাই এরফান আলীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমার ভাই গ্রামের কবরস্থান কমিটিকে বার্ষিক চাঁদা দিত না। কবর দিতে হলে ১০-১২ হাজার টাকা দিতে হতো। কিন্তু আমরা সেটার ব্যবস্থা করতে পারিনি। তাই এখানে লাশ নিয়ে আসতে মানা করেছিলাম।’ বাড়িঘর জমিজমা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘বাড়িতে তাঁর একটিই ঘর ছিল। ছিল কিছু জমিজমা। সবই আমাদের দুই ভাইয়ের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। আমার ভাই বউ ও ভাতিজা-ভাতিজিরা আবার এলে সেই দলিল দেখাব।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চাঁপাইনবাবগঞ্জের সমন্বয়কদের একজন আবদুর রাহিম। তিনি এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ১৫ সেপ্টেম্বর দুপুরে চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরে শহীদ সাটু অডিটরিয়ামে আয়োজিত শহীদ পরিবারের সদস্য ও আহত ব্যক্তিদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় নুরুন্নাহার তাঁর বাবার কথা তুলে ধরেন। এর আগে ঢাকা থেকে আসা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধিরা নুরুন্নাহারের বাবার কবর জিয়ারত করেন। নিহত হিসেবে মতিউর রহমানের তালিকা কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে। তিনি যেন শহীদ হিসেবে স্বীকৃতি পান এবং তাঁর পরিবার যাতে সরকারি সহযোগিতা পায়, সেই চেষ্টা করা হচ্ছে।