ঘরে বসেই নকশিকাঁথা ও টুপি সেলাই কাজের প্রসার ঘটাতে চান সাবিনা-ফেন্সিরা

নওগাঁর ১১টি উপজেলার ৪০টি ইউনিয়নে অনুষ্ঠিত হয়েছে উঠান বৈঠক। জেলাটির পোরশা উপজেলার ঘাটনগর ইউনিয়নের উঠান বৈঠকের একটি চিত্রছবি: প্রথম আলো

ভ্রমণপিপাসুদের পছন্দের স্থান পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার। ১৯৮৫ সালে ইউনেসকো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের মর্যাদা দেয় প্রাচীন এই প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনটিকে। এটি অবস্থিত নওগাঁর বদলগাছী উপজেলার পাহাড়পুর গ্রামে। পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার থেকে ৫০০ মিটার দূরে স্থানীয় মুরশিদা বেগমের বাড়ি। সেখানেই ৪ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় ‘ইন্টারনেটের দুনিয়া সবার’ শীর্ষক প্রচারাভিযানের আওতায় উঠান বৈঠক। ইন্টারনেটের বহুমুখী ব্যবহারে গ্রামীণ নারীদের উদ্বুদ্ধ করতে দেশজুড়ে গ্রামীণফোনের উদ্যোগে চলমান এ উঠান বৈঠকে এসেছিলেন গ্রামটির বাসিন্দা সাবিনা ইয়াসমিন (৩৫)।

আজকের গল্পটি ঐতিহাসিক পাহাড়পুরের নয়, গৃহিণী সাবিনাকে নিয়ে। মা-চাচিদের দেখেই কিশোরী বয়সেই একেকটি কাপড়ে সুইয়ের ফোড়নে নান্দনিক সব নকশা ফুটিয়ে তোলার কাজ শেখেন সাবিনা। তাঁর স্বামী বাবুল আখতার পেশায় কৃষক। বর্তমানে ইন্টারনেটে বিভিন্ন ভিডিও দেখে নতুন নতুন ডিজাইনের জামাকাপড় ও নকশিকাঁথা তৈরি করে আয় করছেন সাবিনা। ইন্টারনেট ব্যবহার করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, বিশেষ করে ফেসবুক ও ইউটিউবে প্রচারের মাধ্যমে নিজের ব্যবসার প্রসার ঘটাতে চান তিনি।

নওগাঁর ১১টি উপজেলার ৪০টি ইউনিয়নে অনুষ্ঠিত হয়েছে উঠান বৈঠক, যা গত ২৪ নভেম্বর শুরু হয় পোরশা উপজেলার ঘাটনগর ইউনিয়ন থেকে। প্রতিটি উঠান বৈঠকে একসঙ্গে শতাধিক নারীর অংশগ্রহণ তৈরি করে উৎসবের আমেজ। এসব বৈঠকে স্মার্টফোন থেকে ‘সার্চ অপশন’ ব্যবহার করে কীভাবে ইন্টারনেটে অনেক কিছু খুঁজে পাওয়া যায়—তা শেখানো হয়। পাশাপাশি তথ্যভিত্তিক বিভিন্ন ভিডিও দেখানো হয়। এসব প্রচারণা গ্রামের অসংখ্য নারীর জীবনে অনুপ্রেরণা জোগাচ্ছে।

ফেন্সি আখতার, বদলগাছী উপজেলার মথুরাপুর ইউনিয়নের পরশুরামপুর গ্রামের বাসিন্দা তিনি। সংসারের কাজের ফাঁকে করেন টুপিতে নকশা তোলার কাজ
ছবি: প্রথম আলো

ফিরে আসা যাক সাবিনা ইয়াসমিনের গল্পে। ছোটবেলায় জামাকাপড় ও কাঁথায় নকশা তোলার কাজ করতেন সাবিনা। বিয়ের পর স্বামীর বাড়িতে এসেও সংসারের কাজ সেরে একটু অবসর পেলেই বসে পড়তেন সুই-সুতা আর কাপড় নিয়ে। নিজের পাশাপাশি স্বামী-সন্তান ও আত্মীয়স্বজনদের ব্যবহারের জন্যই জামাকাপড় ও কাঁথায় নকশা করার কাজ করেন তিনি। এ ছাড়া কেউ অর্ডার দিলে ১ থেকে ৩ হাজার টাকা মজুরি চুক্তিতে প্রতিটি নকশিকাঁথা সেলাই করে দেন। সংসারের কাজের ফাঁকে অবসর সময়ে নকশিকাঁথা সেলাই করে মাসে ৬ থেকে ১০ হাজার টাকা আয় করেন তিনি।

উঠান বৈঠক থেকে নতুন কী শিখলেন? জানতে চাইলে সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, ‘এখানে বড় পর্দায় কয়েকজন সফল নারী উদ্যোক্তার গল্প দেখানো হলো। তাঁরা ইন্টারনেট ব্যবহার নিজের ব্যবসার পরিচিতি ও প্রসার ঘটিয়েছেন। আমিও ফেসবুক ও ইউটিউবে আমার কাজের ভিডিও ছড়িয়ে দিতে চাই। এখন তো আমার কাজ সম্পর্কে গ্রামের লোকজন ও আত্মীয়স্বজন জানেন। ইন্টারনেটে আমার কাজের ভিডিও দিলে দূরদূরান্ত থেকেও লোকজন নকশিকাঁথা সেলাই করে নেওয়ার জন্য আমার কাছে অর্ডার দেবে। এতে আমার ব্যবসা ভালো হবে। আয় বাড়বে।’

বদলগাছী উপজেলার পাহাড়পুর গ্রামের বাসিন্দা সাবিনা ইয়াসমিন। ইন্টারনেটে বিভিন্ন ভিডিও দেখে নতুন ডিজাইনের জামাকাপড় ও নকশিকাঁথা তৈরি করে আয় করছেন তিনি
ছবি: প্রথম আলো

সাবিনার মতো বহু নারী এসব উঠান বৈঠক থেকে এমন অভিজ্ঞতা আর অনুভূতি নিয়ে বাড়ি ফেরেন। তেমনই একজন বদলগাছীর মথুরাপুর ইউনিয়নের পরশুরামপুর গ্রামের বাসিন্দা ফেন্সি আখতার। ৪ ডিসেম্বর সকালে বদলগাছীর পরশুরামপুর গ্রামে অনুষ্ঠিত উঠান বৈঠকে অংশ নেন ফেন্সি আখতার। তিনি টুপিতে নকশার কাজ করেন। ফেন্সি আখতার বলেন, ‘সংসারের কাজের ফাঁকে টুপিতে নকশা তোলার কাজ করি। এতে বাড়তি কিছু আয় হয়। আমি ইন্টারনেট তেমন ব্যবহার করতে পারি না। কোনোমতে ফেসবুকটা চালাতে পারি। এখানে এসে অনেক কিছু শিখলাম। আমরা বাড়িতে বসে যে কাজ করব, ইন্টারনেট ব্যবহার করে নাকি সেটার প্রচার করা যাবে। এটা জেনে খুব ভালো লাগল।’

ইন্টারনেটের বহুমুখী ব্যবহার শেখাতে সারা দেশের দুই হাজারের বেশি ইউনিয়নে চলছে ‘ইন্টারনেটের দুনিয়া সবার’ শীর্ষক আয়োজন।

মানুষের নানাবিধ দৈনন্দিন চাহিদা ও প্রয়োজন মেটাতে ইন্টারনেট যে সক্ষম, সে বিষয়টি তৃণমূলের নারীদের সরাসরি শেখাতেই ইন্টারনেট দুনিয়া সবার উদ্যোগ। প্রথম আলোর পাঠক সংগঠন বন্ধুসভার স্থানীয় সদস্যদের সহযোগিতায় সারা দেশের দুই হাজারের বেশি ইউনিয়নে চলছে উঠান বৈঠক। গ্রামীণফোনের এই উদ্যোগ আয়োজনের সহযোগিতায় রয়েছে প্রথম আলো, নকিয়া, ব্র্যাক মাইক্রোফাইন্যান্স ও ঢাকা ব্যাংক পিএলসি। ২০২৩ সালের মার্চে শুরু হওয়া কার্যক্রমটির আওতায় গতকাল বুধবার (২৫ ডিসেম্বর) পর্যন্ত ২ হাজার ৪৭টি ইউনিয়নে উঠান বৈঠক সম্পন্ন হয়েছে।