পানি কমতেই গোমতীর ভাঙন শুরু, আতঙ্কে মানুষ

বন্যার পানি কমতেই কুমিল্লার মুরাদনগরে দেখা দিয়েছে গোমতী নদীর ভাঙন। গতকাল উপজেলা সদরের দিলালপুর-চৌধুরীকান্দি এলাকায়ছবি: প্রথম আলো

ভারত থেকে নেমে আসা ঢল ও টানা বৃষ্টিতে এ বছর গোমতী নদীর ভয়াবহ রূপ দেখেছে কুমিল্লার মানুষ। বাঁধ ভেঙে গোমতীর পানির স্রোতে কুমিল্লার কয়েকটি উপজেলা তলিয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। এরই মধ্যে কমে গেছে গোমতীর পানি। তবে পানি কমতেই জেলার মুরাদনগর উপজেলায় দেখা দিয়েছে নদীভাঙন। এতে আতঙ্কে দিন কাটছে নদীপারের মানুষের।

মুরাদনগর উপজেলা সদরের দিলালপুর, চৌধুরীকান্দিসহ কয়েকটি স্থানে নদীর ভাঙনের পরিমাণ বেশি বলে স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) কুমিল্লার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বিষয়টির খোঁজখবর রাখছেন তাঁরা। ভাঙন রোধে বরাদ্দের জন্য এরই মধ্যে বিষয়টি পাউবোর প্রধান কার্যালয়ে জানানো হয়েছে।
স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন, গত চার–পাঁচ দিনের মধ্যে অন্তত ১০টি বাড়িঘর ভেঙে পড়েছে নদীতে। কুমিল্লার গোমতী নদীর জোয়ার-ভাটা নেই। যার কারণে অতীতে অনেক সময় কিছুটা ভাঙলেও বর্তমানের মতো এভাবে নদীভাঙনের দৃশ্য দেখা যায়নি। গোমতী নদী হয়ে বন্যার পানি তীব্র স্রোতে নামার কারণে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে বলে মনে করছেন স্থানীয় লোকজন।

স্থানীয় লোকজনের ভাষ্য, বর্তমানে ওই এলাকায় নদীভাঙনের ঝুঁকিতে আছে অর্ধশতাধিক পরিবারসহ কৃষিজমি। এ ছাড়া ঝুঁকিতে রয়েছে গোমতী নদীর বেড়িবাঁধও। দ্রুতই ভাঙন রোধ করা না গেলে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাবে কয়েকটি গ্রামসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। এ নিয়ে নদীপারের মানুষের নির্ঘুম রাত কাটছে।

স্থানীয় এলাকার বাসিন্দা নুরুল ইসলাম ও রিপন মিয়া বলেন, মুরাদনগর উপজেলা সদরের চৌধুরীকান্দি, দিলালপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় নদীর তীরবর্তী ঘরবাড়ি ভেঙে নদীতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। গত কয়েক দিনে অনেকে বসতভিটা হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন। এ ছাড়া নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে কবরস্থান, বৈদ্যুতিক খুঁটিসহ মানুষের বিভিন্ন স্থাপনা। নদীর তীরবর্তী আরও কয়েকটি পরিবার নদীভাঙনের আতঙ্কে রাত জেগে থাকছে।

চৌধুরীকান্দি এলাকার বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘এবারের স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় কুমিল্লার বেশির ভাগ পানি নেমেছে গোমতী নদী হয়ে। গোমতী এবার তার ভয়ংকর রূপ দেখিয়েছে। কয়েক বছর আগে গোমতীর ভাঙন আমার বাপ-দাদার বসতভিটা কেড়ে নিয়েছে। ওই বসতভিটার এখন কোনো চিহ্নই নেই। বর্তমানে যেখানে আছি, সেটিও বিলীন হওয়ার পথে। যেভাবে নদী ভাঙছে, এতে আরও অনেক বাড়িঘর ভাঙতে পারে। বর্তমানে পরিবার নিয়ে খুব আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছি।’

আনোয়ারের ভাষ্য, গত ১০ বছরে নদীভাঙনে তাঁর বাবা-দাদার বসতবাড়িসহ আশপাশের এলাকার শতাধিক বাড়িঘর বিলীন হয়েছে। বিগত সময়ে জনপ্রতিনিধিরা ভাঙন রোধে কাজ করার আশ্বাস দিলেও শেষ পর্যন্ত কাজের কাজ কিছুই হয়নি বলে জানান তিনি।

ওই এলাকার রিপন মিয়া জানিয়েছেন, গত কয়েক দিনের ভাঙনে তিনি এবং তাঁর ছেলেদের বসতঘর নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। এতে তাঁরা নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন।
পেশায় সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালক রিপন বলেন, ‘আমার সব শেষ হইয়া গেছে। গোমতী আমরার সব কাইড়া নিসে। থাকনের কোনো জায়গা এখন আর নাই। পোলাপান লইয়া কই যামু, কী করমু, আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। সরকার যদি আমাগো থাকনের ব্যবস্থা কররা না দেয়, তাইলে পথেই থাকতে হইবো। আমরা অনেক কষ্টে আছি।’

দিলালপুর এলাকার বাসিন্দা শাহিনুর বেগম বলেন, ‘চরম আতঙ্কে নদীপারের মানুষের দিন কাটতেছে। অতীতে এত ভয়াবহভাবে নদী ভাঙেনি। এবার নদী দিয়ে তীব্র স্রোত যাওয়ার কারণে পাড় নরম হয়ে গেছে। এ জন্য ভাঙন বেশি বলে মনে হচ্ছে। আমাদের বাড়ির বড় একটি অংশ নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। বাকিটাও এখন ভাঙার পথে।’

আজ বুধবার বিকেলে এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মুরাদনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সিফাত উদ্দিন বলেন, ‘গোমতী নদীর পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে দিলালপুর, চৌধুরীকান্দিসহ কয়েকটি স্থানে নদীভাঙন দেখা দিয়েছে। আমার জানামতে, এখন পর্যন্ত দুটি বাড়ি নদীতে ভেঙে পড়েছে। আমরা এ বিষয়ে খোঁজখবর রাখছি। এরই মধ্যে নদীর পাড়ের অধিক ঝুঁকিপূর্ণ জায়গাগুলো চিহ্নিত করে কুমিল্লা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কর্মকর্তাদের জানানো হয়েছে। সব মিলিয়ে প্রায় আধা কিলোমিটার এলাকা ঝুঁকিপূর্ণ। আশা করছি, দ্রুতই পাউবো নদীভাঙন রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। কুমিল্লায় নদীভাঙনের তেমন কোনো ঘটনা ঘটে না। যার কারণে মানুষ বেশি আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন।’

আজ বিকেলে সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে পাউবো কুমিল্লার নির্বাহী প্রকৌশলী খান মোহাম্মদ ওয়ালিউজ্জামান বলেন, ‘এবার কুমিল্লা জেলায় ভয়াবহ বন্যা হয়েছে। বন্যার পর কিছু কিছু এলাকায় নদীভাঙন স্বাভাবিক বিষয়। সারা দেশেই এমনটা হয়। তবে মুরাদনগরের বিষয়টি আমরা গুরুত্বের সঙ্গে দেখছি। বিষয়টি এরই মধ্যে পাউবোকে অবহিত করে দ্রুত বিশেষ বরাদ্দ দেওয়ার জন্য জানানো হয়েছে।’

ওয়ালিউজ্জামান বলেন, ‘নদীভাঙন রোধ করতে অনেক বেশি টাকার প্রয়োজন। কিন্তু নদীভাঙন রোধে আমাদের নিজস্ব তেমন কোনো বাজেট নেই। যার কারণে আমরা চাইলেই কিছু করতে পারছি না। বরাদ্দ এলে আশা করছি, দ্রুততম সময়ের মধ্যে ওই এলাকায় নদীভাঙন রোধের কাজ শুরু হবে।’