শত বছরের ‘দারোগা মসজিদ’

প্রাচীন স্থাপত্যের নিদর্শন তিনটি গম্বুজ ও ১৪টি মিনারের দৃষ্টিনন্দন সাতকানিয়ার মধ্য রূপকানিয়ার ‘দারোগা মসজিদ’ছবি: প্রথম আলো

সড়কের সঙ্গে লাগানো শানবাঁধানো পুকুর ঘাট। পাশে বিশাল চওড়া ফটক‌। ফটকের ওপর কারুকাজে নির্মিত চারটি মিনার। মাঝখানে একটি ফিরোজা রঙের গম্বুজ। মিনার-গম্বুজের সুউচ্চ ফটক দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলে ১৪টি ছোট-বড় মিনার ও তিনটি গম্বুজবিশিষ্ট প্রাচীন মসজিদ চোখে পড়বে। চট্টগ্রামের সাতকানিয়া পৌরসভার রূপকানিয়া এলাকার এই মসজিদের নাম হেদায়েত আলী চৌধুরী মসজিদ। এলাকাবাসীর কাছে ‘দারোগা মসজিদ’ হিসেবে পরিচিত।

প্রায় ১১৫ বছর আগে মসজিদটি নির্মাণ করা হয়। চারপাশে কারুকাজ করা সীমানাদেয়াল‌। দক্ষিণ পাশে একটি মাদ্রাসা ও মধ্য রূপকানিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। উত্তর পাশে মসজিদের সীমানাদেয়াল ঘেঁষে স্থানীয় মানুষের কবরস্থান। ২০০৬ সালে ফটক ও মসজিদের মাঝামাঝি খালি জায়গা সংস্কার করে নামাজ আদায়ের জন্য মূল মসজিদের সঙ্গে একীভূত করা হয়েছে।

যে কারও দৃষ্টি কাড়ে মসজিদের প্রধান ফটকটি
ছবি: প্রথম আলো

মসজিদ পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক হেলাল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ১৯১০ সালে সাতকানিয়ার ইছামতিরকুল এলাকার উজির আলী চৌধুরী বাড়ির সন্তান হেদায়েত আলী চৌধুরী নিজ উদ্যোগে মধ্য রূপকানিয়া গ্রামে দৃষ্টিনন্দন মসজিদটি নির্মাণ করেন। হেদায়েত আলী চৌধুরী ব্রিটিশ আমলে উত্তর ও দক্ষিণ চট্টগ্রামের বিভিন্ন থানায় দারোগা হিসেবে কর্মরত ছিলেন। অবসর নেওয়ার পর সাড়ে ছয় কানি জমি দান করে মসজিদ নির্মাণ ও একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি। তাঁর নামে মসজিদটি ‘দারোগা মসজিদ’ হিসেবে পরিচিতি পায়। পরে মাদ্রাসার কিছু জায়গা নিয়ে দক্ষিণ রূপকানিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়। বিদ্যালয়টিও ‘দারোগা স্কুল’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠে।

মসজিদটিতে ৪০ বছর ধরে ইমাম হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন লোহাগাড়া উপজেলার চুনতি গ্রামের বাসিন্দা মাওলানা আবু তৈয়ব (৬৪)। তিনি বলেন, মসজিদের গম্বুজগুলো উঁচুতে হওয়ায় প্রাকৃতিকভাবে ভেতরের দালান অনেক ঠান্ডা থাকে। অনেক পথচারী আসা-যাওয়ার পথে মসজিদে বিশ্রাম নেন। পুরোনো ঐতিহ্য ও অপূর্ব নির্মাণশৈলীর কারণে অনেক মানুষ দৃষ্টিনন্দন মসজিদটি দেখতে আসেন।

মসজিদে কথা হয় উপজেলার দস্তিদার হাট এলাকার দর্শনার্থী আবদুল জব্বারের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘ছোটকাল থেকে শুনে আসছি মধ্য রূপকানিয়ার দারোগা মসজিদটি অনেক পুরোনো এবং প্রাচীন ঐতিহ্যের নিদর্শন। পাশের গ্রামে একটি কাজে এসে ঐতিহাসিক মসজিদটি দেখে গেলাম।’

পুরোনো ঐতিহ্য ও অপূর্ব নির্মাণশৈলীর কারণে অনেক মানুষ দৃষ্টিনন্দন মসজিদটি দেখতে আসেন
ছবি: প্রথম আলো

এলাকার প্রবীণ ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলা থেকে ইট, পাথর ও সুরকি এনে মসজিদটি নির্মাণ করা হয়। কারিগরও হুগলি জেলা থেকে আনা হয়েছিল। পাঁচ-ছয় বছর লেগেছে নির্মাণকাজ শেষ করতে। নির্মাণের পর হেদায়েত আলী চৌধুরী নিজেই মোতোয়ালি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর মৃত্যুর পর স্ত্রী রহিমুন্নেসা মসজিদের দেখাশোনা করতেন। তাঁদের একমাত্র মেয়ে মোছাম্মৎ ফাতেমাও মসজিদের দেখাশোনা করেছেন। এখন কমিটির মাধ্যমে মসজিদটি পরিচালিত হয়ে আসছে।

দারোগা মসজিদ প্রতিষ্ঠাতার উত্তরসূরি আনিস ইবনে হাবিব বলেন, ‘মসজিদে প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের পাশাপাশি জুমার নামাজে মুসল্লিরা অংশ নিয়ে থাকেন। মসজিদের পাশে একটি ফোরকানিয়া মাদ্রাসা পরিচালিত হচ্ছে। সেটি বড় মাদ্রাসায় রূপান্তরিত করার পরিকল্পনা আছে। দারোগা মসজিদ আমাদের এলাকার জন্য গর্বের একটি নিদর্শন। এটি সরকারিভাবে রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।’