গ্রামের যে পাইকারি বাজারে প্রতিদিন বিক্রি হয় কোটি টাকার আলু
সীমান্তঘেঁষা ছোট যমুনার দুই পাড়ে কয়েক শ বিঘা আলুর খেত। প্রতিদিন কাক ডাকা ভোর থেকে আলু তোলায় ব্যস্ত গ্রামের নারী-পুরুষ। নদীর ঠান্ডা জলে আলু ধুয়ে পরিষ্কার করে বস্তায় ভরছেন পুরুষেরা। সেখান থেকে সেই আলু সাইকেল ও ভ্যানে যাচ্ছে ৪০০ গজ দূরে গ্রামের ভেতর আলুর অস্থায়ী পাইকারি বাজারে।
দিনাজপুরের হাকিমপুর উপজেলার সীমান্তবর্তী মাধবপাড়া গ্রামের তিনমাথা মোড়ে প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বসে অস্থায়ী এই পাইকারি বাজার। বাজারে প্রতিদিন আগাম জাতের আলুর কোটি টাকার ব্যবসা হচ্ছে। বিরামপুর ও হাকিমপুর উপজেলার কয়েক শ আলুচাষি জমি থেকে আলু সংগ্রহ করে এ বাজারে বিক্রি করছেন।
শনিবার দুপুরে অস্থায়ী বাজারে গিয়ে দেখা গেল, দুই উপজেলার প্রায় ২০টি গ্রামের চাষিরা জমি থেকে টাটকা আলু তুলে অস্থায়ী পাইকারি বাজারে বিক্রি করছেন। এখানে স্থানীয় ১২ জন আড়তদার প্রতিদিন ৫ থেকে ৬ হাজার মণ আলু কিনছেন। এসব আলুর পাইকারি মূল্য কোটি টাকার বেশি।
আলু কেনার পর অস্থায়ী পাইকারি বাজারে এসব আলু ধোয়া, বস্তায় ভরা এবং গাড়িতে ওঠানোর কাজ করছেন অর্ধশতাধিক শ্রমিক। বাজারে দুপুর থেকে আলুচাষি, স্থানীয় আড়তদার, জেলার বাইরের পাইকারি ব্যবসায়ী, আলুশ্রমিক আর পরিবহনশ্রমিকের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। ছোট যমুনা নদীর উভয় পাশের আলুখেত থেকে আলু তোলা, ধোয়া আর পরিবহনে কাজ করছেন আরও দুই শতাধিক নারী-পুরুষ।
অস্থায়ী আলুর বাজারকে কেন্দ্র করে মাধবপাড়া গ্রামের তিনমাথা মোড়ে পাকা সড়কের দুই পাশে বসেছে জিলাপি, ডিম, শীতের রকমারি পিঠা, ঝালমুড়ি আর চায়ের দোকান। ডিসেম্বরের ১৫ তারিখ থেকে এ বাজার বসেছে। চলবে আরও দুই সপ্তাহ। স্থানীয় আড়তদারেরা জানান, এখানে প্রতিদিন রোমানা ও ক্যারেজ জাতের কেনাবেচা হচ্ছে। তবে বর্তমানে ক্যারেজ জাতের আলুই বেশি বিক্রি হচ্ছে। আলুর বাজার থেকে যা খাজনা আদায় হয়, তা গ্রামের পাঁচটি মসজিদের উন্নয়নে খরচ করা হয়। এ ছাড়া আলুর বাজারে অর্ধশতাধিক শ্রমিক দিন শেষে জনপ্রতি ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা আয় করছেন।
চলতি মৌসুমে আলুর উৎপাদন বেশি এবং দাম ভালো পাওয়ায় খুশি স্থানীয় আলুচাষিরা। তাঁরা বলছেন, অস্থায়ী আলুর বাজারে সকালের চেয়ে বিকেলে বেচাকেনা বেশি হয়। গত বছর একই সময়ে রোমানা (লাল) জাতের আলু ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা এবং ক্যারেজ আলু ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা মণ দরে বিক্রি হয়েছিল। এবার বাজারে আলুর চাহিদা বেশি থাকায় ক্যারেজ জাতের আলু ২ হাজার ১০০ থেকে ২ হাজার ৩০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। আর রোমানা জাতের আলু ২ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার ৭০০ টাকা মণ দরে বিক্রি হচ্ছে।
আলুর অস্থায়ী এই বাজার থেকে প্রতিদিন রাজধানী ঢাকাসহ দেশের ১০টি জেলার আড়তে যাচ্ছে। ঢাকা, রংপুর, বগুড়া, নাটোর, পাবনা, সিরাজগঞ্জসহ বিভিন্ন স্থান থেকে আসা পাইকারেরা স্থানীয় আড়তদারদের কাছ থেকে কমিশনে আলু কিনে ট্রাকে করে নিয়ে যান। শনিবার দুপুরে এ বাজারে রোমানা জাতের আলু প্রতি মণ সর্বোচ্চ ২ হাজার ৬০০, ক্যারেজ আলু ২ হাজার ৩০০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে।
বাজারে আলু বিক্রি করতে এসেছেন হাকিমপুর উপজেলার মাধবপাড়া গ্রামের আলুচাষি মো. কাওসার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এবার আমি ৮ বিঘা জমিতে ক্যারেজ জাতের আলু আবাদ করেছি। গতকাল ৩০ মণ আলু বিক্রি করেছি। আজ সাড়ে ২২ মণ এনেছি। এসব আলু ২ হাজার ৩০০ টাকা মণ দরে বিক্রি করলাম। বাজারে আলুর দাম ভালো পেয়েছি।’
বিরামপুর উপজেলার শৈলান গ্রামের আলুচাষি আয়েজ উদ্দিন বলেন, তিনি আজ ১৬ মণ রোমানা জাতের আলু বিক্রি করেছেন। প্রতি মণ আলু বিক্রি হয়েছে ২ হাজার ৫০০ টাকা দরে। জমিতে আলুর উৎপাদন ভালো হয়েছে। তবে এবার আলুবীজ ও সারের দাম বেশি। আলুর দাম আরেকটু বেশি হলে ভালো হতো।
স্থানীয় আড়তদার জাহিদ ইকবাল রানা বলেন, এ বাজারে নতুন জাতের আলু আমদানি হয়। রোমানা জাতের আলু ২ হাজার ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা মণ এবং ক্যারেজ আলু ২ হাজার ২০০ থেকে ৩০০ টাকা মণ দরে কিনছেন। এসব আলু আড়তদারেরা কিনে ঢাকা, রাজশাহী, পাবনা, কুষ্টিয়া, নাটোর, সিরাজগঞ্জ, কিশোরগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলার ব্যবসায়ীদের কাছে পাঠাচ্ছেন।
হাকিমপুর উপজেলার ১ নম্বর খট্টা ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান সদরুল শামীম প্রথম আলোকে বলেন, মূলত এটি আলুর অস্থায়ী পাইকারি বাজার। স্থানীয় চাষিরা কম খরচে আলু বিক্রি করেন। কেনাবেচার সময় যে খাজনা আদায় হয়, সেই অর্থ পাঁচটি মসজিদের উন্নয়নকাজে ব্যয় করা হয়। এ ছাড়া এখানে যেসব স্থানীয় শ্রমিক কাজ করছেন, তাঁরা প্রতিদিন ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা আয় করছেন।