খুলনার শিল্পকারখানা-১
কর্মব্যস্ত শিল্পাঞ্চল এখন ভাঙা হাট
দেশ স্বাধীনের আগে থেকে খুলনায় একের পর এক গড়ে ওঠে শিল্পকারখানা। আশির দশকেও এসব কারখানা ঘিরে ছিল হাজারো মানুষের ব্যস্ততা। একে একে সেগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কর্মসংস্থান হারিয়েছেন মানুষ। ভাটা পড়েছে ব্যবসা-বাণিজ্যে। শিল্পাঞ্চলের বর্তমান অবস্থা নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ থাকছে প্রথম পর্ব।
খুলনার ক্রিসেন্ট জুট মিলের প্রধান ফটকের পাশে টাইলসের বেদিতে ধুলার স্তর জমেছে। দেখেই বোঝা যায়, অনেক দিন কেউ সেখানে বসেনি। কর্মচাঞ্চল্যমুখর এলাকাটি এখন নীরব, নিস্তব্ধ। ফটকের কাছে ঝরাপাতা পরিষ্কার করছিলেন রতন কুমার মণ্ডল। বদলি শ্রমিক হিসেবে ১৯৮৬ সালে তিনি এই কারখানায় কাজ নেন। তাঁর মা–বাবাও শ্রমিক ছিলেন। কারখানা বন্ধের পর বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের (বিজেএমসি) কর্মচারী হিসেবে এখনো কাজ করছেন তিনি।
স্মৃতিচারণা করে রতন কুমার বলেন, ‘ক্রিসেন্টের বিশাল মাঠে মাইক বাজিয়ে ফুটবল খেলা হতো। কত আনন্দ, কত উল্লাস! আমরা যেন স্বর্গে বাস করতাম। বাজারঘাট সব মিলের ভেতরে ছিল। এখন পোড়োবাড়ির মতো মনে হয়। গালে পানি দেওয়ারও মানুষ নেই।’
১৯৫২ সালে প্রতিষ্ঠার পর ৬৮ বছর বহু শ্রমিকের জীবিকা জুগিয়েছে ক্রিসেন্ট জুট মিল। ২০২০ সালের জুলাইয়ে বন্ধের সময় প্রায় ৯ হাজার শ্রমিক কাজ করতেন। কারখানার ১১৩ একর এলাকা গাছগাছালিতে ভরা। শ্রমিক কলোনির ভবনগুলোর জীর্ণদশা। একসময় দুই হাজার পরিবার থাকত সেখানে। এখন দু-একজন নিরাপত্তারক্ষী ও কয়েকটি পরিবার ছাড়া কেউ থাকে না।
২৪ ঘণ্টা শ্রমিক-কর্মচারীর কোলাহলে মুখর থাকত খুলনার শিল্পাঞ্চল। এখন সবই অতীত। সবখানে সুনসান নীরবতা।
ক্রিসেন্ট জুট মিল থেকে বিআইডিসি সড়কের এক কিলোমিটারের মধ্যে প্লাটিনাম জুবিলি জুট মিল। কারখানাটির শ্রমিক কলোনির সারি সারি ভবনগুলো এখন একেবারেই ফাঁকা। প্লাটিনাম ১ নম্বর ফটকের প্রবেশমুখে ‘বরিশাল স্টোর’ নামে ছোট্ট একটি দোকানে কাপড়চোপড় বিক্রি করেন শামসুল আলম। ১৯৭৯ সালে তিনি চুয়াডাঙ্গা থেকে খুলনায় এসে কারখানায় কাজ নেন। পাঁচ সন্তান নিয়ে কারখানার কলোনিতে থাকতেন। এখন বাইরে ভাড়া থাকেন। ব্যবসা মন্দা হওয়ায় গ্রামে ফেরার মনস্থির করেছেন।
শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, আগে প্রতি বৃহস্পতিবার ছিল ঈদের মতো। সেদিন শ্রমিকেরা মজুরি পেতেন। প্রতিটি কারখানার স্থায়ী-অস্থায়ী দোকানে রমরমা কেনাবেচা চলত। সাপ্তাহিক মজুরির দিনে শ্রমিকেরা অভাব বুঝতেন না। শুধু ওই দিনই এই ছোট দোকানে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকার কেনাবেচা হতো। আর এখন বসে বসে সময় কাটে।
দোকানের সামনে রিকশা নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন মো. কালাম। ঝালকাঠি থেকে খুলনায় এসে প্লাটিনাম ও ক্রিসেন্ট কারখানায় বদলি শ্রমিকের কাজ করেছেন। কালাম বলছিলেন, শিফট পরিবর্তনের সময় এ রাস্তা পার হওয়া যেত না। কারখানার গেটে খালি মাথা দেখা যেত। রিকশাচালক থেকে সবজি বিক্রেতা, সবারই ভালো আয় ছিল। এখন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত রিকশা চালালেও ৪০০ টাকা আয় হয় না।
খুলনার প্রায় প্রতিটি কারখানায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল। প্লাটিনাম শ্রমিক কর্মচারী আবাসিক এলাকায় ১৯৬৪ সালে প্লাটিনাম মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। কারখানা বন্ধের পর গত চার বছরে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর সংখ্যা তিন ভাগের এক ভাগে নেমে এসেছে। ২০২০ সালে যেখানে ৭৬৮ জন শিক্ষার্থী ছিল, এখন সেটি ৩১২।
বিদ্যালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মদিজা খানম বলেন, মিল বন্ধের পর পরিবারের সঙ্গে গ্রামে কিংবা অন্য কোথাও চলে গেছে অনেক শিক্ষার্থী। স্কুলের প্রাণচাঞ্চল্যও কমে গেছে।
শুধু ক্রিসেন্ট-প্লাটিনামের মতো রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল নয়, খুলনার মীরেরডাঙ্গা এলাকার সোনালী জুট মিল, অ্যাজাক্স জুট মিল, আটরা শিল্পাঞ্চলের আফিল জুট মিল, শিরোমণি বিসিক শিল্প এলাকার মহসিন জুট মিলসহ বেসরকারি অনেক পাটকলই এখন বন্ধ। সব মিলিয়ে ২৪ ঘণ্টা শ্রমিক-কর্মচারীর কোলাহলমুখর খুলনার শিল্পাঞ্চলে কারখানায় কারখানায় এখন নীরবতা, নিস্তব্ধতা।
যেভাবে গড়ে ওঠে শিল্পকারখানা
গবেষক, শ্রমিক, ব্যবসায়ী ও বিজেএমসি সূত্রে জানা গেছে, ব্রিটিশ আমলে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত পাট ব্যবসার একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ ছিল হিন্দু মাড়োয়ারিদের। পাটকলের পুরোটাই ছিল বর্তমান পশ্চিম বাংলাকেন্দ্রিক। বাংলার পাট দিয়ে সেখানকার পাটকল চলত। দেশভাগের পর পাটকলের কিছুই পূর্ব বাংলায় আসেনি। এরপর সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় পূর্ব পাকিস্তানে পাটশিল্পের প্রসার হয়। ষাটের দশকে ভৈরব ও রূপসা নদীর কোল ঘেঁষে খুলনা অঞ্চলে শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও কলকারখানা স্থাপিত হতে থাকে।
বিজেএমসি সূত্র জানায়, ১৯৫২ সালে পাকিস্তান শিল্প উন্নয়ন সংস্থার সহায়তায় খুলনার খালিশপুরে ক্রিসেন্ট ও পিপলস জুট মিল নামে বড় দুটি পাটকল স্থাপিত হয়। এরপর ১৯৫৩ সালে দৌলতপুর জুট মিল, ১৯৫৪ থেকে ১৯৫৬ সালের মধ্যে প্লাটিনাম জুবিলি জুট মিল ও দিঘলিয়ার চন্দনীমহলে স্টার জুট মিল স্থাপিত হয়। এ ছাড়া স্বাধীনতার আগে ইস্টার্ন জুট মিল, আলিম জুট মিল, আফিল জুট মিল, মহসিন জুট মিল, সোনালী জুট মিল ও অ্যাজাক্স জুট মিল স্থাপিত হয়। পাকিস্তান শিল্প উন্নয়ন সংস্থা ও পরে পূর্ব পাকিস্তান শিল্প উন্নয়ন সংস্থার সহযোগিতায় সব কারখানা ব্যক্তিমালিকানায় প্রতিষ্ঠিত হয়। দেশ স্বাধীনের পর পাটকলগুলো রাষ্ট্রীয়করণ করা হয়। গঠন হয় বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশন।
পাটকলের বাইরে ১৯৫৯ সালে ভৈরব নদের তীরে স্থাপিত হয় খুলনা নিউজপ্রিন্ট কারখানা। সেখানে দিন-রাত আড়াই হাজার শ্রমিক কাজ করতেন। কারখানার পাশে ১৯৬৫ সালে দেশের একমাত্র সরকারি হার্ডবোর্ড কারখানাটি স্থাপিত হয়। কানাডার অনুদানে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান শিল্প উন্নয়ন সংস্থা কারখানাটি স্থাপন করে। স্বাধীনতার পর সেটি তত্ত্বাবধান করে বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি)। কয়েকবার বন্ধ-চালুর পর ২০১৩ সালের ২৬ নভেম্বর একেবারে বন্ধ হয়ে যায়।
মোকাম থেকে শিল্পাঞ্চল
দৌলতপুরে আগে থেকেই পাটের বড় মোকাম থাকায় কাঁচামালের সহজলভ্যতা ও সুষম যোগাযোগের কারণে খুলনায় পাটকল স্থাপনের উপযুক্ত জায়গা হয়ে উঠেছিল। রেল যোগাযোগ, ভৈরব নদের যোগাযোগ সুবিধা ও নতুন চালনা (বর্তমানে মোংলা) বন্দর দিয়ে রপ্তানির সুযোগ নিয়ে খুলনা হয়ে ওঠে দেশের পাটশিল্পের বড় কেন্দ্র। একই কারণে ভৈরব নদের তীরে নিউজপ্রিন্ট ও হার্ডবোর্ড কারখানা তৈরি হয়।
প্রগতি জুট সাপ্লাইয়ের স্বত্বাধিকারী শেখ আবদুল মান্নান ৬৬ বছর ধরে পাট ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। ৮৪ বছর বয়সী এই ব্যবসায়ী বলেন, উত্তরাঞ্চল থেকে রেলপথে এবং ফরিদপুর থেকে নৌপথে দৌলতপুর মোকামে পাট আসত। কাঁচামালের সহজলভ্যতা ও সুষম যোগাযোগের কারণে খুলনায় একের পর এক পাটকল গড়ে ওঠে।
খুলনায় ভারী শিল্পের ইতিহাস জানাতে গিয়ে গবেষক গৌরাঙ্গ নন্দী বলেন, খুলনায় পাটকল হওয়ার অনেক আগে থেকেই দৌলতপুরে পাটের বড় মোকাম ছিল। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর খুলনার বয়রা, খালিশপুর, আটরা, রামপাল ও মোংলা এলাকায় অনেক জমি অধিগ্রহণ করে শিল্পকারখানা স্থাপনের উদ্যোগ নেয় তৎকালীন সরকার। তখন শিল্পোদ্যোক্তাদের নামমাত্র মূল্যে জমি দেওয়ার পাশাপাশি ব্যাংকঋণ, ভর্তুকি মূল্যে বিদ্যুৎ ও রপ্তানির ওপর প্রণোদনা দেওয়া হয়। প্রথম দিকে উদ্যোক্তাদের ৯০ শতাংশই ছিল পাকিস্তানি।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, আশির দশকে খুলনা ছিল জমজমাট, ব্যবসাও ছিল চাঙা। তারপরের চিত্র পুরোটাই ভিন্ন। একে একে বন্ধ হতে থাকে বড় বড় কারখানা। ১৯৯৩ সালে খুলনা টেক্সটাইল কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হয়। সেটি ছিল ভারী শিল্প বন্ধের প্রথম ঘটনা। এরপর রাষ্ট্রমালিকানাধীন একমাত্র হার্ডবোর্ড কারখানা, নিউজপ্রিন্ট মিল ও দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরি বন্ধ করা হয়। সর্বশেষ ২০২০ সালের জুলাই মাসে খুলনার সাতটিসহ রাষ্ট্রায়ত্ত সব পাটকল বন্ধ করা হয়।
সম্প্রতি ক্রিসেন্ট জুট মিল মসজিদের সামনে দিয়ে হাঁটছিলেন এক প্রবীণ। ১৯৬৭ সালে পিরোজপুর থেকে যখন তিনি কারখানায় আসেন, তখন তাঁর বয়স ১৭ কি ১৮। শ্রমিকদের সার্ভিস বুক রেকর্ড তৈরির কাজ করা এই প্রবীণের নাম মজিবর রহমান। তিনি বলেন, ‘দেশের সব জেলার লোক এখানে কাজ করত। প্রচুর লোক। জমজমাট অবস্থা। শ্রম দিয়ে যেন আনন্দ-ফুর্তি কেনা। এখন তো ভাঙা হাট। এই হাট আর জোড়া লাগবে কি না, কে জানে?’