২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

দিনরাতে প্রায় ১২ ঘণ্টা বিদ্যুৎ পাচ্ছেন না কয়রার প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষেরা

লোডশেডিং
প্রতীকী ছবি

খুলনার কয়রা উপজেলার ঘুগরাকাটি বাজারে একটি বেকারি কারখানা আছে আমিনুল ইসলামের। ঘনঘন লোডশেডিংয়ের কারণে তাঁর বিস্কুট উৎপাদনের এ কারখানা প্রায় অচল হওয়ার দশা। বিদ্যুৎ না পাওয়ার আক্ষেপ নিয়ে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এক সপ্তাহ ধরে লোডশেডিং যে হারে বাড়িছে, এভাবে চলতি থাকলি কারখানা টিকিয়ে রাখতি পারব কি না, বুঝতিছি নে। দুই দিন কোনো মালামাল তৈরি করতি পারিনি। কর্মচারীদেরও ছুটি দিতি হয়েছে। কী করব, কারেন্ট না থাকলি তো আর কাজ করতি পারিনে।’

ঘুগরাকাটি বাজারে চারটি বিস্কুট কারখানা, তিনটি অটোরাইসমিল (চালকল) ও ছয়টি করাতকল রয়েছে। ঘনঘন লোডশেডিংয়ের কারণে সব কটিরই একই দশা। কেবল এই বাজার নয়, টানা লোডশেডিংয়ে উপজেলার সব জায়গায় এখন চরম ভোগান্তি পোহাচ্ছেন মানুষ। অসহ্য গরমের সঙ্গে লোডশেডিং বাড়ায় দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে মানুষের জীবন। উপজেলা সদরের অবস্থা কিছুটা ভালো হলেও গ্রামে লোডশেডিংয়ের চিত্র ভয়াবহ।

উপজেলায় বিদ্যুতের চাহিদা রয়েছে ১০ মেগাওয়াট। তার জায়গায় সরবরাহ পাচ্ছেন মাত্র ৫ মেগাওয়াট।

উপজেলার হড্ডা গ্রামের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গতকাল বুধবার সকাল ৯টা থেকে আজ বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা পর্যন্ত লোডশেডিং হয়েছে ৭ বার। গতকাল সকাল ৮টায় বিদ্যুৎ যাওয়ার পর আসে সকাল সাড়ে ১০টায়। দুপুর ১২টায় আবারও ১ ঘণ্টা বিদ্যুৎ ছিল না। বেলা সাড়ে তিনটায় বিদ্যুৎ চলে গিয়ে আসে বিকেল পাঁচটায়। এরপর সন্ধ্যা সাতটায় গিয়ে আসে সাড়ে আটটায়। রাত পৌনে ১১টায় আবার বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার পর আসে দিবাগত রাত ১টায়। এক ঘণ্টা থেকে আবারও লোডশেডিং শুরু হয়। বিদ্যুৎ আসে রাত সাড়ে তিনটায়। সকাল ছয়টা থেকে আবারও আড়াই ঘণ্টা লোডশেডিং হয়। সব মিলিয়ে ২৪ ঘণ্টায় গ্রামের মানুষেরা ১১ ঘণ্টার বেশি বিদ্যুৎহীন ছিলেন।

যখন কারেন্টের দরকার ঠিক সেই সময় থাকে না। ছাওয়াল-মেয়েগের পড়াশুনাও লাঠে উঠেছে। পড়তি বসলিই কারেন্ট নেই।
ফাতেমা খাতুন, গৃহিণী, মহেশ্বরীপুর গ্রাম, কয়রা

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, উপজেলার মহেশ্বরীপুর, উত্তর ও দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের প্রত্যন্ত কয়েকটি গ্রামে দিনে কিছুটা সময় বিদ্যুৎ থাকলেও রাতের চিত্র ভয়াবহ। দিনরাত মিলিয়ে সাত থেকে আটবার বিদ্যুৎ যাচ্ছে। সন্ধ্যার পর বিদ্যুৎ চলে গিয়ে গভীর রাতে একবার এলেও তার স্থায়িত্ব এক ঘণ্টার বেশি হচ্ছে না। ওই এলাকার বাসিন্দারা অভিযোগ করেছেন, তাঁদের সঙ্গে বৈষম্য করছে বিদ্যুৎ অফিসের লোকজন।

দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের ব্যবসায়ী কহিনুর আলম বলেন, লোডশেডিংয়ের কথা বলে লাভ নেই। এখানে দিনে তিন থেকে চারবার নিয়ম করে বিদ্যুৎ চলে যায়। প্রতিবার দেড় থেকে দুই ঘণ্টা লোডশেডিং থাকে। আর রাতে একবার গেলে আর আসার খবর থাকে না। দোকানের ফ্রিজে রাখা মালামাল নষ্ট হয়ে লোকসান গুনতে হচ্ছে।

কয়রা উপজেলায় ছয়টি ফিডে বিদ্যুতের মোট গ্রাহক রয়েছেন ৬০ হাজার। সাতক্ষীরা প্রধান গ্রিড থেকে ভায়া হয়ে কয়রার হাতিয়ারডাঙ্গা সাবস্টেশনে যুক্ত হয় বিদ্যুৎ। সেখান থেকে উপজেলার ছয়টি ফিডে ভাগ করে দেওয়া হয়। পল্লীবিদ্যুৎ কয়রা জোনাল অফিসের কর্মকর্তারা বলছেন, যেসব এলাকায় কলকারখানা ও সেচকাজ কম, সেখানে লোডশেডিং বাড়িয়ে অন্য স্থানে কমানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।

মহেশ্বরীপুর গ্রামের গৃহিনী ফাতেমা খাতুন বলেন, ‘যখন কারেন্টের দরকার ঠিক সেই সময় থাকে না। ছাওয়াল-মেয়েগের পড়াশুনাও লাঠে উঠেছে। পড়তি বসলিই কারেন্ট নেই। তখন বই খাতা ফেলে গরমে বাইরে হাঁটাহাটি করতি হয়।’

দক্ষিণ বেদকাশী এলাকার অটোরাইসমিলের মালিক আয়ুব আলী বলেন, কিছুদিন আগে নিয়ম করে বিদ্যুৎ যেত। সেই সময়টা মিলে কাজ বন্ধ রাখতেন। কিন্তু এখন আর কোনো নিয়ম-টিয়ম নেই। কাজ চলা অবস্থায় বিদ্যুৎ উধাও। তখন কী যে সমস্যায় ভুগতে হয়, তা বলে বোঝানো যাবে না।

গৃহিণী ফাহিমা আকতার বলেন, ‘আমার মেয়ে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে। রাতে পড়ার সময় বিদ্যুৎ থাকে না। গরমে কুপির আলোয় পড়াও যায় না। কী করব, সংসারের খরচ বাঁচায়ে তার জন্যি চার্জার লাইট ও ফ্যান কিনতি হয়েছে।’

কয়রা সদরের সুন্দরবন ক্লিনিকের মালিক কামরুল ইসলাম বলেন, লোডশেডিংয়ের কারণে ভর্তি রোগীদের খুব কষ্ট হচ্ছে। তা ছাড়া অনেক জরুরি মুহূর্তে লোডশেডিং হওয়ায় বিপদের কথা ভেবে সার্বক্ষণিক নিজস্ব বিদ্যুতের ব্যবস্থা চালু রাখতে হচ্ছে। এতে অনেক খরচ বেড়ে যাচ্ছে।

কয়রা বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি সরদার জুলফিকার আলী বলেন, বিদ্যুৎ–বিভ্রাটের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন কম্পিউটার কম্পোজ ও ছাপাখানার ব্যবসায়ীরা। বিদ্যুৎ না থাকায় দোকান খুলে তাঁদের বসে থাকতে হচ্ছে। আবার বরফকলগুলোর উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় মাছ ব্যবসায়ীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

খুলনা পল্লীবিদ্যুৎ সমিতির কয়রা জোনাল অফিসের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার (ডিজিএম) কায়সার রেজা বলেন, উপজেলায় বিদ্যুতের চাহিদা রয়েছে ১০ মেগাওয়াট। তার জায়গায় সরবরাহ পাচ্ছেন মাত্র ৫ মেগাওয়াট। এ ছাড়া অতিরিক্ত রোদের কারণে বিদ্যুতের তার গরম হয়ে যায়। যে কারণে লোডশেডিং হচ্ছে। আগামী দু–এক দিনের মধ্যে সমস্যার সমাধান সম্ভব বলে আশা করছেন তিনি।