মৌলভীবাজারের এক গ্রামে একলা এক তমালগাছ

ঝাঁকড়া মাথায় দাঁড়িয়ে থাকা তমালগাছ। মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলার নন্দীউড়ায়ছবি: প্রথম আলো

অগ্রহায়ণের সকাল, হেমন্তকাল। যত দূর চোখ যায়, হালকা কুয়াশায় মাখামাখি হয়ে আছে গাছপালা, ঘরবাড়ি, পথের দুই পাশের ধূলিধূসর ঘাস। এই সময়ে গাছপালা শরীর থেকে একটু একটু করে সবুজকে সরাতে চাইছে। পাতারাও কিছুটা খয়েরি হয়েছে, হাওয়ায় দুলছে। এ রকম একটা সকালে এই বাংলার পথে চলতে চলতে এক-দুবার জীবনানন্দ দাশকে মনে না পড়ে উপায় নেই।

এই তো ‘অঘ্রান এসেছে আজ পৃথিবীর বনে;/ সে সবের ঢের আগে আমাদের দুজনের মনে/ হেমন্ত এসেছে তবু...।’ হেমন্তের অমন সোনার সকালে একটি গ্রামের ভেতর একলা একটি গাছের কাছে এসে আরও কিছু পঙ্‌ক্তি মনের ভেতর জলের মতো ঘুরে ঘুরে কথা বলতে থাকে। ‘এমনই হিজল-বট-তমালের নীল ছায়া বাংলার অপরূপ রূপ...।’ ওখানে, ওই গ্রামে হেমন্তের সোনার সকালে পুরো শরীরে নীল ছায়া মেখে একলা দাঁড়িয়ে ছিল একটি তমালের গাছ।

শনিবার একদম সকালবেলা মৌলভীবাজার-রাজনগর-ফেঞ্চুগঞ্জ-সিলেট সড়ক দিয়ে চলতে গিয়ে একটি গাছের সঙ্গে দেখা। তখন হালকা কুয়াশায় অনেকটাই শান্ত, স্থির প্রকৃতির সব। একটু করে রোদ জাগছে। মানুষ, যানবাহনের চলাচল তখনো অতটা সচল হয়ে ওঠেনি। এক-দুটি গাড়ি শাঁ করে ছুটে যাচ্ছে। গ্রামের ভেতর থেকে এক-দুজন রাস্তায় বেরিয়ে এসে পায়চারি করছেন। দু-একজন বাড়ির পাশের সবজিখেতে কাজ করছেন। অগ্রহায়ণ এসে দুয়ারে পৌঁছালেও সোনার ফসল ঘরে তুলতে, কাস্তে নিয়ে মাঠে ঝাঁপিয়ে পড়তে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। এই পথেই হঠাৎ একটি স্থানে একটি একলা, গোল ছাউনির মতো গাছের সঙ্গে দেখা। মৌলভীবাজার-রাজনগর-ফেঞ্চুগঞ্জ-সিলেট সড়কের পশ্চিম পাশে, সড়ক থেকে অল্প কিছু দূরে গাছটি। সড়ক থেকে তখন এক তরুণ ঠেলাগাড়িতে বালু বোঝাই করে বাড়িতে নিচ্ছিলেন। তাঁর কাছে গাছটির পরিচয় জানতে চাইলে তিনি বললেন, গাছটি ‘তমাল’। তমালের এই গ্রামের নাম নন্দীউড়া। মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলার রাজনগর সদর ইউনিয়নের একটি গ্রাম।

চারপাশের অনেক গাছের ভিড়ে তমালগাছটি আলাদাই। তার চেহারা, শরীর ভরা ঘন ছায়া তাকে অন্যদের থেকে পৃথক করেছে, পৃথক সৌন্দর্য দিয়েছে। অনেকে হয়তো তমালের নাম শুনেছেন। কিন্তু গাছটি পথে-প্রান্তরে হুট করে চোখে পড়ে না। যে কারণে অনেকের কাছে অচেনা থাকারই সম্ভাবনা বেশি। কী আর করা! গাছটির মায়া অমনই। গাছটির কাছে থামতে হয়েছে।

ওই তরুণের নাম মহিম মালাকার। তিনি জানালেন, গাছটি তাঁদের বাড়িতেই। বাড়ির দিঘির পাড়ে অনেক অনেক বছর ধরে আছে তমালগাছটি। কে রোপণ করেছেন, কীভাবে ওখানে উঠেছে, তা তাঁর জানা নেই। গাছটির বয়স নিয়েও তাঁর পরিষ্কার ধারণা নেই। তাঁর মতে, তাঁর বাবার বয়স এখন প্রায় ৭০ বছর। বাবা ছোটবেলা থেকে গাছটিকে দেখেছেন বলে তাঁদের জানিয়েছেন। এতে তরুণের অনুমান, গাছটির বয়স ১০০ তো হবেই। আবার অন্যদের ধারণা, অতটা না–ও হতে পারে। তবে গাছটি যে অনেক ঝড়ঝাপটা সয়ে ৫০ পেরিয়ে গেছে, এ নিয়ে কারও কোনো দ্বিধা নেই।

মহিম মালাকার জানিয়েছেন, এখন গাছটির পাতা ঝরার সময়। আস্তে আস্তে পাতা ঝরে যাবে। বৃষ্টি হলে আবার পাতা ফুটবে, পাতায় ভরে উঠবে গাছটি। তখন গাছের ডালে ছোট ছোট ফুল ফুটবে। তারপর ফল আসে। অনেক পাখি আসে। গাছটি দেখতে অনেক মানুষ আসেন। গাছটি যে দিঘির পাড়ে ঝাঁকড়া মাথায় দাঁড়িয়ে আছে, ১২ মাস পথিকের চোখ কাড়ছে; সেই দিঘিতে আষাঢ়-শ্রাবণজুড়ে ফুটে থাকে পদ্মফুল। এবারও অনেক পদ্মফুল ফুটেছিল। সেই ফুলও টানে ব্যস্ত সড়কের পথচারীদের।

পাশেই সবজিখেতে জোড়া মহিষের হাল দিয়ে আলু রোপণের জন্য মাটি প্রস্তুত করছিলেন মিহি রঞ্জন দাশ। তিনি বলেন, ‘গাছটিতে বরইয়ের (কুল) মতো অনেক ফল আসে। অনেকে নিয়ে যান।’

গাছটিকে এক পাশ থেকে দেখতে সবুজ ত্রিভুজের মতো মনে হতে পারে। আবার কিছুটা দূর থেকে দেখলে মনে হয়, গাছটি শাখা-প্রশাখায় পাতার গাঢ় ছাউনিতে বিশাল ছাতার মতো হয়ে আছে। গাছের নিচে এদিক-ওদিক প্রায় সব সময় জমা হয়ে থাকে শান্ত, শীতল ছায়া। পরিষ্কার তল। গাছটির গোড়া মাটি দিয়ে লেপা। ডালে ডালে কোথাও এক-দুটি, কোথাও অনেকটা ফল ঝুলে আছে। ফলগুলো দেখতে এখন অনেকটা কাঁচা বরইয়ের মতো।

তমালগাছের কথা বলতে গিয়ে অনুকূল মালাকার শোনালেন ‘না পোড়াইও রাধা অঙ্গ/ না ভাসাইও জলে/ মরিলে বাঁধিয়ে রেখো/ তমালের ডালে...।’ তমালগাছ চেনা থাক বা না থাক, বহুজনের মুখে মুখে এই পঙ্‌ক্তিগুলো ছড়িয়ে আছে। বাংলার অপরূপ প্রকৃতির মাঝে, গাছগাছড়ার ভেতর তমাল আছে তার পৃথক রূপ, সৌন্দর্য, নীল ছায়ার মায়া নিয়ে। নন্দীউড়ার তমালটি তার রূপ-লাবণ্য নিয়ে এখনো টিকে আছে, হয়তো আরও বহুকাল পথিকের চোখে মুগ্ধতা ছড়িয়ে টিকে থাকবে। শত বছর পেরিয়ে আরও কোনো শত বছরের কাছে পৌঁছাবে।