মেয়ে বলেছিল বাজার থেকে আম আনতে, বাবা ফিরলেন গুলিবিদ্ধ লাশ হয়ে
দিনমজুর মো. সাইফুল ইসলামের (৩৭) ঘরের চাল চুয়ে পানি পড়ে। জীর্ণ ঘরটি ভেঙে নতুন ঘর তৈরি করতে চেয়েছিলেন। এ জন্য ধান বিক্রি করতে যান বাজারে। ধান বিক্রি শেষে ছোট্ট মেয়েটির জন্য আম কিনে বাড়িতে ফেরার কথা ছিল তাঁর, কিন্তু তা আর হয়নি। সাইফুল ফিরলেন লাশ হয়ে। কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সংঘর্ষের সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনি মারা যান।
নিহত সাইফুল ইসলামের বাড়ি ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলার চক ঢাকিরকান্দা গ্রামে। তিনি ওই গ্রামের তৈয়ব আলীর ছেলে। অল্প কিছু জমি বন্ধক রেখে চাষ করতেন সাইফুল। সেই সঙ্গে দিনমজুরি করেই সংসার চালাতেন। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। পরিবারের ভাষ্য, ২০ জুলাই দুপুরে ফুলপুর-ময়মনসিংহ সড়কের আমুয়াকান্দা এলাকায় সংঘর্ষের সময় একটি গুলি এসে সাইফুলের ডান চোখের ওপরে লেগে মাথা ছিদ্র করে বেরিয়ে যায়। পরে তিনি মারা যান।
গতকাল রোববার দুপুরে চক ঢাকিরকান্দা গ্রামে নিহত সাইফুলের বাড়িতে গিয়ে জীর্ণ ঘর দেখা যায়। স্বামীকে হারিয়ে সন্তানদের নিয়ে অথই সাগরে পড়েছেন স্ত্রী রহিমা আক্তার। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ধান নিয়ে সেদিন তাঁর স্বামী বাজারে গিয়েছিলেন। যাওয়ার সময় ছোট মেয়ে বলেছিল আম নিয়ে আসতে। ধান বিক্রি করে আম নিয়ে বাড়ি ফেরার কথা ছিল তাঁর। কিন্তু পুলিশের গুলিতে তাঁর স্বামী লাশ হয়ে বাড়ি ফেরেন।
স্বজনেরা বলছেন, সাইফুলের মৃত্যুর পর তাঁর দাদা আফতাব উদ্দিন (৮০) মারা গেছেন ২৩ জুলাই। নাতির মৃত্যু সইতে না পেরে তিনিও মারা যান।
প্রথমে সন্তান ও পরে বাবার লাশ কাঁধে নিয়ে কবরস্থানে দাফন করেন কৃষক তৈয়ব আলী। তিনি বলেন, তাঁর বেঁচে থাকা না-থাকা এখন সমান কথা। তাঁর নিরপরাধ ছেলেকে গুলি করে মারা হয়েছে। সরকারের কাছে এর বিচার চান।
দুই মেয়ে ও এক ছেলের বাবা ছিলেন সাইফুল। বড় মেয়ে মিম আক্তার (৬) প্রথম শ্রেণিতে পড়ে। ছেলের রামিম হাসানের বয়স ৪ বছর। অপর মেয়ের সাইমা আক্তারের বয়স ২ বছর ৪ মাস। বাড়ির সামনে দেখা গেল শিশু রামিম হাসানকে। আইসক্রিম খাচ্ছিল সে। বাবা মারা যাওয়ার বিষয়টি এখনো সে বুঝে উঠতে পারেনি।
সাইফুলের সঙ্গে সেদিন ধান বিক্রি করতে যান তাঁর ছোট ভাই শহীদুল ইসলাম। সাইফুল গুলিবিদ্ধ হওয়ার সময় পাশেই ছিলেন তিনি। শহীদুল বলেন, বেলা একটার দিকে আমুয়াকান্দা বাজারের ধানমহালে ছিলেন। ব্যাপারীর সঙ্গে ধানের দরদামও হয়। এ সময় গন্ডগোল শুরু হয়। গাড়ি থেকে ধান নামানোর আগেই হঠাৎ একটা গুলি এসে সাইফুলের চোখের ওপর দিকে লেগে মাথা ছেদ করে বেরিয়ে যায়। দ্রুত তাঁকে ফুলপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়। সেখানকার চিকিৎসক ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পরামর্শ দেন। হাসপাতালে নেওয়ার পথে সাইফুল মারা যান। পরে তাঁর লাশ বাড়িতে নিয়ে আসেন। শহীদুল আরও বলেন, ‘সে সময় সেখানে শুধু পুলিশ ছিল। পুলিশে গুলি করছে। বিচার কার কাছে দেব আমরা? বিচারের কিছু আছে? পুলিশে গুলি করছে, মামলা কার কাছে দেব?;
এ বিষয়ে ফুলপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহবুবুর রহমান বলেন, নিহত ব্যক্তির পরিবারের পক্ষ থেকে কেউ মামলা করতে আসেননি। তিনি আরও বলেন, যে সময়ের ঘটনা, সে সময় পুলিশ সেখানে ছিল না।
বাড়ির পাশে সাইফুলকে দাফন করা হয়েছে। তাঁর কবরেই পাশেই দাদার কবর। কবরস্থানে পাওয়া যায় নিহত সাইফুলের বড় ভাই বাবুল মিয়া ও ছোট ভাই হাফিজুল হককে। তাঁদের দাবি, পুলিশের গুলিতেই তাঁদের ভাই মারা গেছেন। মারা যাওয়ার তিন দিন পর পুলিশ ফোন করছিল থানায় যাইতে। কিন্তু তাঁরা থানায় যাননি। আল্লার কাছে বিচার দিয়ে রেখেছেন। তাঁরা মামলা করবেন না। নিহত ভাইয়ের তিন ছেলেমেয়ের দেখাশোনার দায়িত্ব নেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানান তাঁরা।