জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব: প্রথম আলোর অনুসন্ধান
স্বপ্নভঙ্গের শঙ্কায় জলবায়ু–উদ্বাস্তু শিশুরা, উচ্ছেদ আতঙ্কে বড়রা
শিখন স্কুলে পড়ানো হয় পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত।
এ মাসের পর ১২ হাজার শিশু শিক্ষা থেকে ঝরে পড়ার ঝুঁকিতে।
স্কুলগুলোর মেয়াদ বাড়ানোর উদ্যোগ নেই।
কক্সবাজার শহরের ১ নম্বর ওয়ার্ডের নাজিরারটেকে গত ২৭ অক্টোবর সকালে যে ১৩ বছরের মেয়েটিকে দেখা গেল শুঁটকিমহালে কাজ করতে, তাকেই আবার দুপুরে দেখা গেল স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে বসে লেখাপড়া করতে। মেয়েটির নাম মরিয়ম আক্তার। একই স্কুলে ১৪ বছর বয়সী মোহাম্মদ বাবু নামের যে ছেলেটিকে দুপুর ১২টায় দেখা গেল ক্লাস করতে, তাকেই আবার বিকেলে পাওয়া গেল আরেকটি শুঁটকিমহালে শ্রমিকের কাজে।
জানা গেল, মরিয়ম নামের মেয়েটার বাবা পাঁচ বছর ধরে কারাগারে। তাই সে বাড়তি আয়ের জন্য মায়ের সঙ্গে সকাল ৬টা থেকে শুঁটকিমহালে কাজ করে বেলা ২টা থেকে স্কুলে যায় পড়ালেখা শিখতে। আর বাবুর বাবা বছর পাঁচেক আগে সাগরে মাছ ধরতে গিয়ে নিখোঁজ হন। তাই পরিবারের হাল ধরতে ছেলেটা স্কুলে সকালের শিফট শেষ করে দুপুর ১২টায় কাজ করতে যায় শুঁটকিমহালে।
স্কুলের শিক্ষক ২৫ বছর বয়সী জোছনা আক্তার জানালেন, বাবু ও মরিয়মের মতো অনেক শিশুই এসব স্কুলে পড়ালেখার পাশাপাশি শুঁটকিমহালে শ্রমিকের কাজ করছে। কাজ বন্ধ রাখতে বললে শিশুরা বলে, কাজ না করলে ওদের পরিবারে খাবার জুটবে না।
এই ছেলেমেয়েদের জীবন যেমন বিচিত্র, তাদের স্কুলও তেমন বিচিত্র ধরনের। এগুলোর নাম ‘শিখন স্কুল’। স্কুলের এই দুই শিক্ষার্থী-কাম-শিশুশ্রমিক ও
এই জলবায়ু-উদ্বাস্তুরা গত তিন প্রজন্ম ধরে শিক্ষাবঞ্চিত। শহরের মধ্যে হলেও উদ্বাস্তু শিবিরে কোনো বিদ্যালয় বানায় না সরকার। কারণ, খাসজমিতে কোনো প্রতিষ্ঠান করার বিধান নেই। উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার আওতায় কিছু ‘শিখন স্কুল’ করা হয়েছে। একেকটি স্কুলে ৩০ থেকে ৬০ জন শিশুকে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি করিয়ে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদান করা হচ্ছে।
তাদের শিক্ষিকার কথার সূত্র ধরে প্রথম আলো অনুসন্ধানে নামে। পাওয়া যায় জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতের এক করুণ কাহিনি; জানা যায় একটি জনপদের ১২ হাজার শিশু আর ৪০ হাজার নারী-পুরুষের ‘শূন্যে ভাসা’ জীবনের গল্প। তাদের কোনো ভিটা নেই, ভূমি নেই, স্থায়ী ঠিকানা-জীবন-স্বপ্ন কিছুই নেই। তাদের পরিচয় শুধু জলবায়ু-উদ্বাস্তু। বছরের পর বছর পেরিয়ে যায়, তাদের দায়িত্ব নেয় না রাষ্ট্র-সরকার; উল্টো যেন প্রহসন করে প্রশাসন। পৌর এলাকার আয়তন বাড়িয়ে তাদের শহরবাসী করা হয়েছে; অথচ গ্যাস, পানি, ড্রেনেজ, হাসপাতাল, শিক্ষালয় দেওয়া হয়নি। এমনকি আবাসভূমিও নিজেদের নয়, সরকারের। এখন সেখানে রাষ্ট্রীয় স্থাপনার জন্য চলছে বিপুল কর্মযজ্ঞ। তাই দেখে উদ্বাস্তু মানুষগুলো ধুঁকছে উচ্ছেদ-আতঙ্কে। তাদের পুনর্বাসনের জন্য ফ্ল্যাটবাড়ি নির্মাণের কাজ শুরু হলেও তাতে ঠাঁই হবে না প্রায় অর্ধেকের। বাকি অর্ধেকের আশ্রয় অনিশ্চিত।
এই জলবায়ু-উদ্বাস্তুরা গত তিন প্রজন্ম ধরে শিক্ষাবঞ্চিত। শহরের মধ্যে হলেও উদ্বাস্তু শিবিরে কোনো বিদ্যালয় বানায় না সরকার। কারণ, খাসজমিতে কোনো প্রতিষ্ঠান করার বিধান নেই। উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার আওতায় কিছু ‘শিখন স্কুল’ করা হয়েছে। একেকটি স্কুলে ৩০ থেকে ৬০ জন শিশুকে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি করিয়ে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদান করা হচ্ছে। এরপর এই শিক্ষার্থীদের কী হবে, তার কোনো নীতিমালা নেই। সরকারপক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, আশপাশের কোনো মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ওদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ভর্তি করানোর কথা। কিন্তু আশপাশে কোনো মাধ্যমিক বিদ্যালয় নেই। অথচ এসব শিখন স্কুল শেষ হয়ে যাবে এই ডিসেম্বরেই। মেয়াদ বাড়ানোরও কোনো উদ্যোগ নেই। এ রকম অস্থায়ী ও অসম্পূর্ণ এক ব্যবস্থায় পড়ে প্রায় ১২ হাজার শিশু রয়েছে শিক্ষা থেকে ঝরে পড়ার ঝুঁকিতে। আর তাদের মা-বাবারা রয়েছেন আরেক দফা উদ্বাস্তু হওয়ার শঙ্কায়।
মাঝখানের প্রায় ৪ হাজার একর জমিতে গড়ে ওঠা ওই জলবায়ু-উদ্বাস্তু শিবিরে এখন ঠিক কত মানুষের বাস, তার সঠিক সংখ্যা পৌরসভা বা জেলা প্রশাসন কারও কাছে নেই।
বিপর্যয়ের শুরু
১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে সর্বস্ব হারিয়ে এক কুতুবদিয়া উপজেলা থেকেই প্রায় ৪০ হাজার মানুষ এসে আশ্রয় নেন কক্সবাজারের সদর উপজেলার সমুদ্র উপকূলের ঝিলংজা ইউনিয়নে। সেখানকার বিশাল আয়তনের খাসজমিতে তাঁরা মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নেন। এলাকাটি এখন কক্সবাজার পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডে পড়েছে। এর উত্তর-পশ্চিমে বঙ্গোপসাগর, পূর্বে কক্সবাজার বিমানবন্দর আর দক্ষিণে বিমানবাহিনীর নির্মীয়মাণ ঘাঁটি। মাঝখানের প্রায় ৪ হাজার একর জমিতে গড়ে ওঠা ওই জলবায়ু-উদ্বাস্তু শিবিরে এখন ঠিক কত মানুষের বাস, তার সঠিক সংখ্যা পৌরসভা বা জেলা প্রশাসন কারও কাছে নেই। তবে এই ওয়ার্ডের পরপর তিনবারের নির্বাচিত কাউন্সিলর (এখন সাবেক) আকতার কামালের হিসাবে, অন্তত ৫২ হাজার মানুষ বসবাস করছেন এখানে। গত তিন দশকে এখানে তৈরি হয়েছে ১৯টি পাড়া-মহল্লা। এর মধ্যে নাজিরারটেক মহল্লায় গড়ে উঠেছে দেশের বৃহত্তম শুঁটকিপল্লি। সেখানকার ছোট–বড় ৮০০ মহালে প্রতিবছর উৎপাদিত হয় প্রায় ৩০০ কোটি টাকার শুঁটকি। পাশাপাশি পচা মাছ ও উচ্ছিষ্ট দিয়ে তৈরি হয় ১৫০ কোটি টাকার শুঁটকিগুঁড়া, যা দেশের বিভিন্ন স্থানে চলে যায় পোনা মাছের খাদ্য হিসেবে। এসব শুঁটকিমহালে খুবই কম মজুরিতে কাজ করেন এখানকারই অন্তত ৩৭ হাজার বাসিন্দা। এর মধ্যে ১২ হাজার নারী আর ৭ হাজারের বেশি শিশু শ্রমিক।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, চকরিয়ার হারবাং, কৈয়ারবিল, ডুলাহাজারা চা–বাগান, মালুমঘাট, হাসের দিঘি, খুটাখালী বাজারের পশ্চিম পাশে, টেকনাফের হ্নীলার মিনাবাজার এলাকাতেও সরকারি জমিতে মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিয়েছেন আরও অন্তত ৩০ হাজার জলবায়ু-উদ্বাস্তু। এসব এলাকাতেও অন্তত তিন হাজার শিশু পড়ালেখার সুযোগ থেকে বঞ্চিত।
এই ওয়ার্ডে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির উপযোগী শিশু আছে ১২ হাজার। এর মধ্যে শিখন স্কুলে পড়ছে ৯০০ শিশু। পুরো ওয়ার্ডে হাতেগোনা কয়েকটি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কিছু মক্তব-মাদ্রাসায় পড়ছে চার হাজারের মতো শিশু। বাকি আট হাজার শিশুই শিক্ষা থেকে বঞ্চিত।সদ্য সাবেক কাউন্সিলর আকতার কামাল
অল্পবিদ্যার ‘শিখন স্কুল’
২০২২ সালে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর অধীনে জেলার বিভিন্ন উপকূল ও দুর্গম এলাকায় ৩১০টি শিখন স্কুল গড়ে তোলা হয়। বর্তমানে এসব স্কুলে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হয়। সেখানে শিক্ষার্থী মোট ১২ হাজার ৩০০। এর মধ্যে মেয়েশিশু ৬ হাজার ৬৮৩। কক্সবাজার পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডে আছে ৩০টি শিখন স্কুল। প্রতিটি স্কুলে ভর্তি হয় ৩০ জন করে মোট ৯০০ জন।
সদ্য সাবেক কাউন্সিলর আকতার কামাল প্রথম আলোকে বলেন, এই ওয়ার্ডে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির উপযোগী শিশু আছে ১২ হাজার। এর মধ্যে শিখন স্কুলে পড়ছে ৯০০ শিশু। পুরো ওয়ার্ডে হাতেগোনা কয়েকটি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কিছু মক্তব-মাদ্রাসায় পড়ছে চার হাজারের মতো শিশু। বাকি আট হাজার শিশুই শিক্ষা থেকে বঞ্চিত।
এর কারণ জানতে চাইলে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শহিদুল আজম বলেন, ১ নম্বর ওয়ার্ডের পুরোটাই সরকারি খাসজমি। তাতে জলবায়ু উদ্বাস্তু ও ভাসমান লোকজনের বসতি। খাসজমিতে সরকারি স্কুল স্থাপনে জটিলতা থাকায় সম্ভব হচ্ছে না।
গত ২০, ২২ ও ২৭ অক্টোবর এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত শিশুদের উপস্থিতিতে মুখর থাকে শিখন স্কুল। দল বেঁধে শিশুরা স্কুলে আসে-যায়। আর পাঁচটা সাধারণ স্কুল থেকে ভিন্ন এই শিখন স্কুল। কয়েক বছর ধরে শিশুরা হাতে-কলমে শিখছে ছবি আঁকা, গল্প বলা, সংগীত-সাহিত্য চর্চা; পাচ্ছে খেলাধুলারও সুযোগ। পোশাক, বই, খাতাপত্র, কলমসহ আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র পাচ্ছে বিনা মূল্যে।
শিখন স্কুলের এ শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা স্কাস। পাঠদান কার্যক্রম দেখভাল করেন সংস্থার ২৫ জন সুপারভাইজার। শিশুদের নিয়মিত কৃমিনাশক ও আয়রন ট্যাবলেটও খাওয়ানো হয় বিনা মূল্যে।
স্কাস, কক্সবাজারের প্রকল্প ব্যবস্থাপক জায়েদ নুর প্রথম আলোকে বলেন, ১০ মাস ধরে শিখন স্কুলের তিন শতাধিক শিক্ষক-কর্মচারীর বেতন বন্ধ। ভর্তি হওয়া অনেক শিশু ইদানীং স্কুলে আসছে না।
স্কাসের চেয়ারম্যান জেসমিন প্রেমা বলেন, দরিদ্র পরিবারের শিশুদের স্কুলে আকর্ষণ করতে প্রতি মাসে ১২০ থেকে ৩০০ টাকা করে উপবৃত্তি দেওয়া হয়। কিন্তু ডিসেম্বরে পঞ্চম শ্রেণির পাঠ শেষ হলে এই শিক্ষার্থীদের ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হওয়া অনিশ্চিত। গত জানুয়ারি থেকে শিখন স্কুলের অর্থ বরাদ্দও আটকে আছে। তার পরও শিশুদের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে পাঠদান চালু রাখা হয়েছে।
নির্দেশিকা বনাম বাস্তবতা
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর ‘আউট অব স্কুল চিলড্রেন কর্মসূচি’র বাস্তবায়ন নির্দেশিকা ঘেঁটে দেখা যায়, সেখানে যেসব লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও নিয়মনীতির কথা বলা হয়েছে, তার সঙ্গে এই শিখন স্কুলগুলোর বাস্তবতার কোনো মিল পাওয়া যায় না। ওই নির্দেশিকায় বলা আছে, ‘উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা আইন অনুযায়ী উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য হচ্ছে, বিদ্যালয়বহির্ভূত ও ঝরে পড়া শিশুদের শিক্ষার বিকল্প সুযোগ সৃষ্টি, শিক্ষার সুযোগবঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে সাক্ষরতা জ্ঞানদান, জীবনব্যাপী শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে জীবিকায়ন দক্ষতা উন্নয়ন, দক্ষ মানবসম্পদে পরিণতকরণ এবং আত্মকর্মসংস্থানের যোগ্যতা সৃষ্টিকরণ।’
এসব গালভরা বুলি শুধু লিখিতই রয়ে গেছে। নির্দেশিকায় বলা আছে, স্কুলগুলো প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত ৬ মাস করে আর চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণি ১২ মাস করে—এই মোট ৪২ মাস বা সাড়ে ৩ বছর মেয়াদি হবে। কিন্তু এখানকার স্কুলগুলো চালু হয়েছে ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে; শেষ হবে এই ডিসেম্বরে। তাহলে মেয়াদ হলো তিন বছর। তার ওপর বছরখানেক ধরে শুরু হয়েছে অর্থসংকট।
ওই স্কুলে কথা হয় শিক্ষার্থী জয়নাব আক্তারের (১২) সঙ্গে। সে ভালো ইংরেজি বলতে পারে। গণিতও ভালো বোঝে। ‘লেখাপড়া করে চিকিৎসক হওয়ার ইচ্ছা আমার’ হাসিমুখের কথাটা মুহূর্তে মিলিয়ে যায়। কারণ, ডিসেম্বরে পঞ্চম শ্রেণি শেষ হলে কোথায় ভর্তি হবে, শিশুটির জানা নেই।
স্বপ্নভঙ্গের শঙ্কা শিশুমনে
শহরের ১ নম্বর ওয়ার্ডের উত্তর পাশে বঙ্গোপসাগর। কক্সবাজার বিমানবন্দরের পশ্চিম পাশে সৈকত-লাগোয়া উত্তর কুতুবদিয়াপাড়া। গ্রামটিতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ার উপযোগী শিশু আছে দুই শতাধিক, কিন্তু কোনো বিদ্যালয়ই নেই। ৩০টি শিশু পড়ছে একটি শিখন স্কুলে; ২২ জনই মেয়ে।
ওই স্কুলে কথা হয় শিক্ষার্থী জয়নাব আক্তারের (১২) সঙ্গে। সে ভালো ইংরেজি বলতে পারে। গণিতও ভালো বোঝে। ‘লেখাপড়া করে চিকিৎসক হওয়ার ইচ্ছা আমার’ হাসিমুখের কথাটা মুহূর্তে মিলিয়ে যায়। কারণ, ডিসেম্বরে পঞ্চম শ্রেণি শেষ হলে কোথায় ভর্তি হবে, শিশুটির জানা নেই।
স্কুলে পাশাপাশি বসে পড়ছে দুই ভাইবোন হুসনে আরা (১২) ও তৌহিদুল ইসলাম (১১)। দুজনেরই পরনে নীল জামা। সামনে বই-খাতা। তাদের বাবা কেফায়ত উল্লাহ বিমানবন্দরের উন্নয়নকাজের শ্রমিক।
লেখাপড়া শিখে কী করতে চাও, প্রশ্ন করলে হুসনে আরা বলে, পাইলট আর তৌহিদুল বলে চিকিৎসক। ‘ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে ঘরে পানি ঢুকলে তখন কী করো?’ তৌহিদুলের জবাব, ‘নানার বাড়ি চকরিয়ায় চলে যাই।’
এদের মতো শিখন স্কুলগুলোর মোট ১২ হাজার শিশুমনের স্বপ্ন, লেখাপড়া শিখে মানুষ হবে তারা। কিন্তু পরিস্থিতি স্বপ্নভঙ্গের মতো।
স্কুলে গিয়ে দেখা যায়, জোছনা আক্তার নামের একজন শিক্ষক শিশুদের নামতা পড়াচ্ছেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ডিসেম্বর শেষেই এই শিশুরা ষষ্ঠ শ্রেণিতে উঠবে। কিন্তু এলাকায় কোনো মাধ্যমিক বিদ্যালয় নেই। আট কিলোমিটার দূরে কক্সবাজার শহরে সরকারি-বেসরকারি সাত-আটটি বিদ্যালয় থাকলেও এত দূরে সন্তানদের পাঠানোর আগ্রহ বা সামর্থ্য কোনোটাই নেই অভিভাবকদের।
সমিতি পাড়ার একটি শিখন স্কুলের শিক্ষক ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, অভাব-অনটনে পড়ে বহু শিশু শ্রমিকের কাজ করছে।
’৯১-এর দুর্যোগে ঘরবাড়ি হারিয়ে কুতুবদিয়ার আলী আকবরডেইল ইউনিয়নের তাবলের চর থেকে স্ত্রী মোতাহেরা বেগমকে নিয়ে উত্তর কুতুবদিয়াপাড়ায় মাথা গোঁজার ঠাঁই করেন আলাউদ্দিন। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে তাঁর ৮, ১০ ও ১২ বছর বয়সী ২ মেয়ে ও ১ ছেলে ভেসে যায়। কোলের দুই শিশুকন্যা বেঁচে যায়। আলাউদ্দিনের বয়স এখন ৬৫। আগের মতো এখন আর সাগরে মাছ ধরতে পারেন না। শুঁটকিমহালে শ্রমিকের কাজ নিয়ে সংসারের হাল ধরেছেন স্ত্রী মোতাহেরা। তাঁদের বেঁচে যাওয়া দুই মেয়ে রুখসানা (৩৫) ও নাসিমা (৩৩) লেখাপড়া শিখতে পারেননি।
১৭ বছর বয়সে রুখসানার বিয়ে হয়। সাগরে মাছ ধরতে গিয়ে তাঁর স্বামী নিখোঁজ হন। তাঁদের ছেলে রাশেদ (১৭) শহরের একটি স্কুলে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে এখন ইজিবাইক (টমটম) চালায়। আর মেয়ে তাসমিয়া (৯) শিখন স্কুলে পড়ছে পঞ্চম শ্রেণিতে।
স্কুলপ্রাঙ্গণেই কথা হয় মোতাহেরা বেগমের সঙ্গে। নাতনিকে আনা-নেওয়া করেন তিনি। প্রথম আলোকে বলেন, সুযোগ না থাকায় তিনি নিজেও আর ঘূর্ণিঝড়ে উদ্বাস্তু হওয়ার কারণে দুই মেয়েও শিক্ষিত হতে পারেননি। নাতি-নাতনিরাও সেই পথেই হাঁটছে।
পাশের কুতুবদিয়াপাড়া, পশ্চিম কুতুবদিয়াপাড়া, নাজিরারটেক, সমিতিপাড়ায় আরও ১০-১২টি শিখন স্কুলে পড়ছে তিন শতাধিক শিশু। এলাকাজুড়ে ময়লা-আবর্জনার ছড়াছড়ি, শুঁটকির দুর্গন্ধ, মশা-মাছির উৎপাত মিলিয়ে অস্বাস্থ্যকর এক পরিবেশ। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে অধিকাংশ ঘরবাড়ি সাগরের পানিতে তলিয়ে যায়। এলাকায় ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রও নেই; লোকজনকে ছুটতে হয় সাত-আট কিলোমিটার দূরে শহরেরটায়।
লেখাপড়া শিখে কী করতে চাও, প্রশ্ন করলে হুসনে আরা বলে, পাইলট আর তৌহিদুল বলে চিকিৎসক। ‘ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে ঘরে পানি ঢুকলে তখন কী করো?’ তৌহিদুলের জবাব, ‘নানার বাড়ি চকরিয়ায় চলে যাই।’
কর্মকর্তারা বিভ্রান্ত
জানতে চাইলে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো কক্সবাজার কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. মেহেদী আল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, এই ডিসেম্বরে শিখন স্কুলের পঞ্চম শ্রেণি সম্পন্ন করা ১২ হাজার শিক্ষার্থীকে আশপাশের বিদ্যালয়ে ভর্তির সরকারি নির্দেশনা রয়েছে। ১০-১৪ বছর বয়সী শিশুদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি আবশ্যক করা হয়েছে। এলাকায় স্কুল না থাকলে কিংবা দূরের এলাকায় এরা যেতে না চাইলে সে ক্ষেত্রে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হবে। তখন বিকল্প ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. নাছির উদ্দিন বলেন, কক্সবাজার শহরে সরকারি-বেসরকারি ১১টি উচ্চবিদ্যালয় রয়েছে। কিন্তু সেগুলোতে শিখন স্কুলের শিক্ষার্থীদের ভর্তির সুযোগ না থাকার বিভিন্ন কারণ তুলে ধরে তিনি বলেন, এদের জন্য কাছাকাছি কোথাও আলাদা ব্যবস্থা দরকার।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) নিজাম উদ্দিন আহমেদ বলেন, শিখন স্কুলের ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের আশপাশের স্কুলে ভর্তির নির্দেশনা আছে। কিন্তু সংকটও আছে। জানুয়ারিতে ভর্তির সময় সমস্যা দেখা দিলে তখন সিদ্ধান্ত জানাবে সরকার।
জলবায়ু-উদ্বাস্তুরা হবে বাস্তুহারা
জলবায়ু-উদ্বাস্তু শিবিরের ঘরে ঘরে বিরাজ করছে উচ্ছেদ–আতঙ্ক। কক্সবাজার বিমানবন্দরের রানওয়ে সম্প্রসারণ এবং বিমানবাহিনীর ঘাঁটি নির্মাণের জন্য সব খাসজমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। পতিত আওয়ামী লীগ সরকার ২০১১ সালে ২১টি পৃথক তালিকায় এখানকার ৪ হাজার ৪০৯টি জলবায়ু-উদ্বাস্তু পরিবারের নাম নিবন্ধন করে; যেখানে মানুষের সংখ্যা ৩০ হাজারের বেশি। পরে এদের জন্য বিমানবন্দরের পূর্ব পাশের বাঁকখালী নদীর ওপারে খুরুশকুল এলাকায় নির্মাণ শুরু হয় পাঁচতলাবিশিষ্ট ১৩৭টি ভবনের বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্প। এটি বাস্তবায়ন করছে সেনাবাহিনী।
জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, দুই বছর আগে ২০টি পাঁচতলা ভবনে বিনা মূল্যে ফ্ল্যাটবাড়ির মালিকানা পেয়েছে ৬০০ পরিবার। বেশির ভাগই ভিক্ষুক, জেলে, শুঁটকি-শ্রমিক। এখন আরও ৮৫টি ভবন প্রস্তুত হয়েছে। তাতে ঠাঁই হবে আরও ২ হাজার ৭২০ পরিবারের।
জানতে চাইলে সাবেক কাউন্সিলর আকতার কামাল বলেন, আশ্রয়ণ প্রকল্পে ফ্ল্যাটবাড়ি পাচ্ছেন না, এমন পরিবারের সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন হাজার আর সদস্য অন্তত ২০ হাজার। তা ছাড়া ২০১৬ সালে আগের তালিকা হালনাগাদ করা হয়। তাতে ১ হাজার ৪০০ পরিবারকে বাদ দিয়ে সমানসংখ্যক নতুন পরিবার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এ নিয়ে বাদ পড়া ২০-২২ হাজার জলবায়ু উদ্বাস্তুর মনে বিরাজ করছে ভয় ও অসন্তোষ। এভাবে একদিকে উচ্ছেদ-আতঙ্ক, অন্যদিকে ছেলেমেয়েদের শিক্ষার অনিশ্চয়তা; এর সঙ্গে জীবন-জীবিকারও অনিশ্চয়তা—সব মিলিয়ে এক দুর্বিষহ পরিস্থিতির মাঝে হাবুডুবু খাচ্ছেন জলবায়ু-উদ্বাস্তু শিবিরের হাজার হাজার মানুষ।