গানে, আড্ডায় কি আন্দোলনে প্রীতিলতার মেয়েরা সবখানে

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রীতিলতা হল। সম্প্রতি তোলা
প্রথম আলো

দুপুরবেলার বৃষ্টি সদ্য থেমেছে। পরিষ্কার আকাশে ঝকঝকে সাদা মেঘ। বৃষ্টিতে ভিজে কাছে দূরের পাহাড়গুলো হয়ে উঠেছে আরও সবুজ। বিকেলের নরম আলোয় বইছে মৃদুমন্দ বাতাস। এতে ভেসে আসছে গিটারের টুংটাং ধ্বনি। আধভেজা একটা সাদা উঠানের মাঝখানে গোল হয়ে বসেছেন কয়েকজন। তাঁদেরই কলকল হাসির ঝরনায় শূন্য উঠানের বিস্তীর্ণ নির্জনতা যেন প্রাণ পেয়েছে।

ভেসে আসছে গান—

‘দিকে দিকে এ কী শুনি সময়ের জয়গান
ব্যথা ভুলে ছুটে চলো ভুলে সব অভিমান’

গানের সুর ধরে এগিয়ে গেলাম তাঁদের দিকে। ফারহানা, জান্নাত, বিপাশা, তিরু, ইরিন, ফারিহা—তাঁরা সবাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রীতিলতা হলের ছাত্রী। গানের মাঝে মাঝে কথা হলো তাঁদের সঙ্গে।

সারা দিনের ক্লাস, পরীক্ষা, ল্যাবের ধকল সেরে বিকেলবেলাটা তাঁদের আড্ডার সময়। ক্যানটিন থেকে গরম শিঙাড়ার ঘ্রাণ ভেসে আসতেই চায়ের কাপে জমে ওঠে গল্পগুজব। তুমুল তর্কবিতর্ক থেকে সুরের গুঞ্জন—সব চলে এখানে। গিটার নামিয়ে রেখে ফারহানা জানান, ‘সারা দিন পর এই আড্ডাটাই আমাদের চাঙা করে তোলে।’

সারা দিনের ক্লাস, পরীক্ষা, ল্যাবের ধকল সেরে বিকেল বেলায় আড্ডা জমে ওঠে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রীতিলতা হলের মাঠে আর বারান্দায়
ছবি: প্রথম আলো

হলের সব বারান্দায়, কার্নিশে এমন ছোট-বড় জটলা দেখা গেল। দোতলার ক্যানটিনের সামনেই খোলা ছাদ। নিচ দিয়ে চলে গেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের রাস্তা। সামনে উপাচার্য ভবন লাগোয়া ঘন গাছে ঘেরা পাহাড়ে হেলে পড়ছে বিকেল। কমলা রঙের রোদে বসে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছিলেন হলের ছাত্রীরা।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার থেকে সোজা রাস্তা। হাতের ডানে বঙ্গবন্ধু উদ্যান পেরিয়ে কিছু দূর যেতেই চোখে পড়বে হলুদ নামফলক—‘প্রীতিলতা হল’। হলের মূল ফটকের এক পাশেই দেয়ালচিত্র। অগ্নিযুগের অগ্নিকন্যা প্রীতিলতা। ভেতরে ঢুকতেই লম্বা করিডর। শুরুতে অতিথিকক্ষ, হল অফিস। এরপর একটি কেচিগেট। গেট পেরোলে দুই পাশে দুটি দোকান আর নাকবরাবর হলের ডাইনিং রুম।

রোজ দুবেলা এখানে খাওয়াদাওয়া করেন হলের মেয়েরা। ডাইনিংয়ের একপাশের দেয়ালে নোটিশ বোর্ডের ওপরে প্রীতিলতার প্রতিকৃতি আঁকা। পাশে বিস্তারিতভাবে লেখা রয়েছে এই বিপ্লবী নারীর জীবন ও সংগ্রামের বীরত্বগাথা। দোতলায় রয়েছে ক্যানটিন, প্রার্থনাকক্ষ ও টিভি রুম। হলের বারান্দার দুই পাশজুড়ে নানা রকম ফুল ও পাতাবাহারের টব। পড়াশোনার পাশাপাশি চলে গাছের পরিচর্যাও।

পাখির চোখে দেখতে প্রীতিলতা হলটি অনেকটা ডানা মেলা প্রজাপতির মতো। ১৯৯৩ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় ছাত্রী হল হিসেবে নির্মিত হয় এটি। নামকরণ করা হয় ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতাসংগ্রামের অন্যতম বিপ্লবী নেত্রী প্রীতিলতার ওয়াদ্দেদারের নামে। প্রীতিলতার জন্ম ও বেড়ে ওঠা চট্টগ্রামেই। পাহাড়তলির মরণচূড়ায় ঝাঁপ দিয়েছিল যে অগ্নি, তার তেজ আজও ছড়িয়ে আছে এখানকার পাহাড়ে পাহাড়ে। এই মহীয়সী নারীর বীরত্বগাথা পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দিতেই হলের নামকরণ করা হয় প্রীতিলতা হল।

২৯ বসন্ত পেরিয়ে এ হলেরও দেয়ালে দেয়ালে জমেছে বর্ণিল সব গল্প। বাংলাদেশের প্রায় সব অঞ্চল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসা ছাত্রীরা থাকেন আবাসিক হলগুলোতে। বৈচিত্র্যময় ধর্ম–বর্ণ–ভাষা–সংস্কৃতির মেলবন্ধন ঘটে এসব হলে। এ যেন শিব্রাম চক্রবর্তীর ‘সর্বধর্মসমন্বয়’–এর চমৎকার এক উদাহরণ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রীতিলতা হলও তা–ই। একেক কক্ষে চারজন, কোথাও কোথাও সাত-আটজনও থাকতে দেখা যায়। একই কক্ষে একদিকে বিছানো জায়নামাজ, আরেকদিকে রাখা বুদ্ধের মূর্তি। অন্যদিকে হয়তো থাকছেন থামি পরিহিত কোনো পাহাড়ি ছাত্রী। যে যাঁর পরিচয় নিয়ে গড়ে তুলেছেন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি।

হলে সংস্কৃতির বিনিময়ও চলে সমানতালে। কেউ ছুটিতে বাড়িতে গেলে অন্য রুমমেটদের জন্য মায়ের হাতের খাবার আনতে হয়। হলে থাকার অলিখিত নিয়ম এটি। প্রীতিলতা হলের ছাত্রী জান্নাত জানান, ‘হলের একঘেয়ে খাবার খেয়ে খেয়ে বিরক্ত হয়ে যাই আমরা। বাড়ির খাবার পেলে তখন কাড়াকাড়ি পড়ে যায়। এই করতে গিয়ে অনেক সময় আমারই জোটে না। তারপরও বাড়ির খাবার সবাই মিলে ভাগ করে খেতে ভালো লাগে।’

হলের প্রতিটি দেয়ালেই নানা রকম রঙিন নকশা বা ছবির দেখা মিলল। বুনো ফুল, লতা, পাখি, প্রজাপতি, চুলখোলা কিশোরী, আরও নানা রকম দেয়ালচিত্র আঁকা। এগুলো কারা আঁকেন, জানতে চাইলে শিক্ষা ও গবেষণা বিভাগের ছাত্রী মুমু চক্রবর্তী জানান, প্রতিবছর শীতের দিকে ব্লক পিকনিক হয়। ১০টি কক্ষ নিয়ে একটি ব্লক। ব্লকের সব কক্ষের মেয়েরা চাঁদা তুলে একসঙ্গে রং, তুলি ইত্যাদি কিনে নিজেদের ব্লক সাজিয়ে তোলেন।

শীতকালজুড়েই একের পর এক ব্লকগুলোতে চলতে থাকে এমন উৎসব। পিকনিকের দিন সকাল থেকে একসঙ্গে রান্নাবান্না হয়। বিকেলে সাজগোজ, ছবি তোলা বা বান্ধবীরা মিলে শাড়ি পরে ঘুরতে যাওয়া। হল ফিস্টের অভাব পূরণ করতে মেয়েরা এভাবে ব্লক পিকনিক আয়োজন করে থাকেন।

হল ফিস্ট হচ্ছে হলের মেয়েদের সবচেয়ে বড় আনন্দ উৎসব। ২০১৮ সালের পর থেকে নানা কারণে মেয়েরা এ আনন্দ থেকে বঞ্চিত। তবে হলজীবনে আনন্দের জন্য উপলক্ষ লাগে না। রাত জেগে চাঁদ দেখা থেকে শুরু করে বান্ধবীর জন্মদিন—সবকিছুর উদ্‌যাপন হয় এখানে।

বর্তমানে প্রীতিলতা হলে থাকা ছাত্রীর সংখ্যা এক হাজারের বেশি। কিন্তু আসনসংখ্যা তার অর্ধেক। হলটিতে কোনো গণরুমও নেই। তবে আবাসনসংকটের কারণে রুমগুলোই একেকটি গণরুমের আকার ধারণ করেছে। আবার আবাসিকের চেয়ে অনাবাসিক ছাত্রীর সংখ্যা বেশি প্রীতিলতা হলে।

সর্বশেষ ২০১৯ ও ২০২২ সালে প্রীতিলতা হলে আসন বরাদ্দের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। তবে কিছু জটিলতার কারণে এত দিন ছাত্রীদের আসন বরাদ্দ করা সম্ভব হয়নি। ছাত্রীরা হলে উঠতে চাইলে হল অফিস থেকে ৬০০ টাকার বিনিময়ে একটি সাময়িক অনুমতিপত্র দেওয়া হয়। এই অনুমতিপত্রের মেয়াদ এক বছর। বর্তমানে বেশির ভাগ মেয়ে সাময়িক হিসেবে হলে থাকছেন। চলতি বছর প্রীতিলতা হলে ছাত্রীদের আসন বরাদ্দের কার্যক্রম চলছে বলে জানান বর্তমান প্রভোস্ট মো. আবদুল্লাহ আল মামুন।

বিশ্ববিদ্যালয় হলের ডাল নিয়ে হরেক রকম গল্প প্রচলিত। প্রীতিলতা হলে গিয়ে এসব গল্পের কিছু সত্যতা মিলল। খাবার টেবিলে রাখা ডালের রং আর হাত ধোয়া পানির রঙে তফাত করা কঠিন। ডাইনিংয়ের খাবার নিয়ে হলের মেয়েদের অভিযোগের শেষ নেই। করোনার পর খাবারের দাম বাড়ানো হলেও মান আগের চেয়ে কমেছে। খাবারের মান বাড়ানোর দাবিতে মেয়েদের আন্দোলনে নামার ঘটনাও বিরল নয় প্রীতিলতা হলে। তবে তাতে খুব একটা রদবদল হয়নি বলে জানালেন হলের আরেক শিক্ষার্থী সাদিয়া।

প্রীতিলতার মতোই তেজদীপ্ত আপসহীন এই হলের ছাত্রীরাও। বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকোনো আন্দোলন-সংগ্রামে এগিয়ে থাকেন তাঁরা। গত বছর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন নিপীড়নবিরোধী আন্দোলনেও প্রথম ডাক আসে প্রীতিলতা হল থেকেই। তবে চার-পাঁচ বছর ধরে আগের মতো ঘটা করে আর পালন হয় না প্রীতিলতার জন্ম–মৃত্যুবার্ষিকী। এ নিয়ে আক্ষেপ আছে হলের মেয়েদের।

এত না পাওয়ার মধ্যেও হলজীবনের স্বর্ণালি দিনগুলোর গল্প ফিরে ফিরে আসে প্রীতিলতার সাবেক ছাত্রীদের মুখে। তবু রংতুলি হাতে নিয়ে হলের শেওলাপড়া দেয়াল সাজিয়ে তোলেন তাঁরা পরম মমতায়। পরিত্যক্ত কোনো কোণে ছোট্ট টবে ফুটিয়ে তোলেন নয়নতারা অথবা টগর ফুল। বিশ্ববিদ্যালয়জীবন শেষে চলে যাওয়ার সময় অশ্রুসিক্ত নয়নে কোনো অনুজের হাতে সে চারাটি তুলে দিয়ে হয়তো বলেন, ‘দেখে রাখিস।’

তারপর জীবন বয়ে যায় নিজের নিয়মে। অনেক দূরে কর্মব্যস্ত অফিস কিংবা সংসারের ফাঁকে যখন কেউ বিকেলের চায়ের কাপ হাতে নেন, তখন হয়তো তাঁদের মনে পড়ে প্রীতিলতার বারান্দা।

পুরোনো বিকেল থেকে ভেসে আসে পুরোনো কোনো সুর—
‘এসো মিলে আমরা মেতে উঠি জীবনের আনন্দে
এই তো সেই সময় শুনেছি সুরেরই ছন্দে
চলো এই ক্ষণে আমরা
তাকে স্বাগত জানাই…’