গুলিতে ঝরে গেল বিপ্লব, নূরে আলম ও জোবায়েরের জীবন
কল পেয়ে বাইরে গিয়েছিলেন বিপ্লব হাসান (২০), স্ত্রীর ওষুধ আনতে যাচ্ছিলেন নূরে আলম সিদ্দিকী ওরফে রাকিব (২০) এবং দোকান খুলতে বের হয়েছিলেন জোবায়ের আহমেদ (২১); তাঁরা সবাই গুলিতে মারা গেছেন। ২০ জুলাই ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার ডৌহাখলা ইউনিয়নের কলতাপাড়া বাজার এলাকায় কারফিউ ভেঙে বিক্ষোভকারীরা সড়কে অবস্থান নেন। এ সময় পুলিশের সঙ্গে তাঁদের সংঘর্ষ হয়। এই তিনজন গুলিবিদ্ধ হন, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে তাঁদের মৃত ঘোষণা করা হয়।
বিপ্লবের গুলি লাগে ঘাড়ে ও পিঠে এবং নূরে আলম ও জোবায়েরের বুকের বাঁ পাশে। সেদিন রণক্ষেত্রে পরিণত হয় কলতাপাড়া এলাকা। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাও (ওসি) গুলিবিদ্ধ হন সেদিন। পুড়িয়ে দেওয়া হয় পুলিশের দুটি গাড়ি।
কল পেয়ে বাইরে যান বিপ্লব
বাজারে নাশতা করবেন বলে মায়ের কাছে টাকা চেয়েছিলেন বিপ্লব। এর মধ্যে একটি কল পেয়ে তিনি চলে যান। পরে পরিবারের লোকজন তাঁর মৃত্যুর খবর পান। কথাগুলো বলছিলেন ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার কলতাপাড়া এলাকায় ২০ জুলাই নিহত তিনজনের একজন বিপ্লব হাসানের মা বিলকিস আক্তার।
গতকাল সোমবার দুপুর ১২টার দিকে বিপ্লবদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির সামনেই বিপ্লবকে দাফন করা হয়েছে। স্বজনেরা বলেন, বিপ্লব হাসান স্থানীয় মোজাফফর আলী ফকির উচ্চবিদ্যালয় থেকে ২০২৩ ও ২০২৪ সালের এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিলেও দুবারই অকৃতকার্য হন। রিকশার মিস্ত্রি বাবার একার আয়ে সংসার চালাতে কষ্ট হয় দেখে স্থানীয় এক তেলের কলে চাকরি নেন তিনি।
বিলকিস আক্তার বলেন, ‘শুনেছি যখন দুজন মারা গেছে, সেই লাশগুলো আমার ছেলে তুলে আনতে যায়। তখন পুলিশ আমার ছেলেকে গুলি করে। মানুষের কাছে শুনতেছি, পুলিশ পাড়া দিয়ে আমার ছেলেকে গুলি করছে। সবাই দেখেছে, পুলিশের গুলিতে আমার ছেলে মারা গেছে।’
বিপ্লবের বাবা বাবুল মিয়া বলেন, ‘আমার ছেলে কোনো রাজনীতি করত না। প্রশাসনের গুলিতে আমার ছেলে মারা গেল, সরকারের কাছে এই বিচারের আবেদন জানাই।’
অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীর জন্য ওষুধ আনতে যান নূরে আলম
চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীর পেটে ব্যথা হওয়ায় ওষুধ কিনতে বের হয়েছিলেন নূরে আলম। সংঘাতে নিহত তিনজনের একজন তিনি। তিনি গৌরীপুর উপজেলার রামগোপালপুর ইউনিয়নের দামগাঁও মধ্যপাড়া গ্রামের আবদুল হালিমের ছেলে। হেফজ বিভাগ শেষ করে ঈশ্বরগঞ্জের ভাসা মাদ্রাসায় পড়ছিলেন নূরে আলম। একই সঙ্গে নিজেদের বাড়িতে তা’লিমুল কোরআন মহিলা মাদ্রাসা নামে একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে সেখানে শিক্ষকতা করছিলেন।
গতকাল নূরে আলমের বাড়িতে গেলে পরিবারের সদস্যরা বলেন, ১৯ জুলাই আত্মীয়র বাড়িতে বিয়ের অনুষ্ঠানে যান নূরে আলমের মা–বাবা। তাঁরা বাড়িতে এসে দেখেন, ছেলে নেই। পরে লোকজন খবর দেন, ছেলের গুলি লেগেছে। লোকজনের মুখে শুনেছেন, সংঘর্ষের ঘটনা ভিডিও করার সময় পুলিশ তাঁকে গুলি করে।
ছেলের মৃত্যুর খবর পেয়ে অচেতন হয়ে পড়েন মা নূরুন নাহার। নূরে আলমের লাশ বাড়িতে রেখে স্বজনেরা তাঁকে নিয়ে যান ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে চিকিৎসা শেষে কিছুটা সুস্থ হলেও একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে পাগলপ্রায় তিনি। বাবা আবদুল হালিম বলেন, ‘বিচার কই দিমু? বিচার চাইলে তো আর আমার ছেলে পাইতাছি না। আমার ছেলে কোনো রাজনীতি করত না। তারপরও জীবন দিল।’
বাড়িতে কথা হয় ভগ্নিপতি মো. ইলিয়াস মাহমুদের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘নূরে আলমের নিজের একটি ইউটিউব চ্যানেল আছে। ইসলামি ভিডিও বানিয়ে নিজের ইউটিউব চ্যানেলে দিতেন তিনি। মানুষের কাছে শুনেছেন, ভিডিও করার সময় তাঁকে গুলি করা হয়। নূরে আলমের মোবাইল ফোনটিও পাওয়া যায়নি।’
দোকান খুলতে যাচ্ছিলেন জোবায়ের
২০ জুলাই নিহত আরেকজন হলেন জোবায়ের আহমেদ। উপজেলার পূর্ব কাউরাট গ্রামের আনোয়ার উদ্দিনের ছেলে তিনি। পাঁচ বোন ও তিন ভাইয়ের মধ্যে তিনি অষ্টম ছিলেন। তাঁর মা নূরজাহান বেগম বলেন, ‘সন্তান হত্যার বিচার প্রধানমন্ত্রীর চেম্বারে দিছি। উনি যেডা ভালো মনে করেন, আমি সেটাতেই রাজি। আমি থানায় কার নামে অভিযোগ করব, আমি তো সেখানে ছিলাম না।’
জোবায়েরের বাবা অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক আনোয়ার উদ্দিন বলেন, ২০২৩ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় এক বিষয়ে অকৃতকার্য হওয়ার পর জোবায়ের ব্যবসা শুরু করেন। ময়মনসিংহের শম্ভুগঞ্জে তাঁর মোবাইলের দোকান আছে। এক বছর আগে ছেলে বিয়ে করেছিলেন। এর সঙ্গে তিনি যুক্ত করেন, ‘দোকান ঠিকঠাক আছে কি না, তা দেখে ফেরার কথা ছিল ছেলের। পথেই মারা গেল। ছেলের লাশ বাড়িতে আনার পর দেখিছি শরীরের বুকের বাঁ পাশে আঘাত। কারা গুলি করল, কার গুলিতে মারা গেল, জানি না। প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিচার দিলাম।’
জোবায়ের ছোট ভাই মো. কাউসার বলেন, ‘কলতাপাড়া হয়েই আমার ভাই শম্ভুগঞ্জ যেত। বাড়ি থেকে যাওয়ার পথে কলতাপাড়া বাজারে আন্দোলনকারী ও পুলিশের গন্ডগোলের মাঝে পড়ে গিয়ে আমার ভাই মারা গেছে।’
ময়নাতদন্ত হয়নি, পুলিশ বলছে দুষ্কৃতকারীরা গুলি করেছে
বিপ্লব হাসান, নূরে আলম সিদ্দিকী ও জোবায়ের আহমেদের মৃত্যুর ঘটনায় পরিবারগুলোর পক্ষ থেকে কোনো মামলা হয়নি। গৌরীপুর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. শফিকুল আলম বাদী হয়ে ২২ জুলাই থানায় একটি মামলা করেন। অজ্ঞাত পরিচয় চার থেকে পাঁচজনকে আসামি করে হত্যা মামলা হয়েছে। মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, ‘অজ্ঞাতনামা দুষ্কৃতকারীদের পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্র মোতাবেক বন্দুকধারী চার থেকে পাঁচজন গুলি করে তিন তরুণকে হত্যা করে।’
এই তিন পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, লাশ তিনটির সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত করা হয়নি।
এলাকায় গ্রেপ্তার–আতঙ্ক
গৌরীপুর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. অনীক ইসলাম বাদী হয়ে ২১ জুলাই বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা করেন। মামলায় ডৌহাখলা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান এম এ কাইয়ুমকে আসামি করা হয়েছে। তিনি গৌরীপুর আসনে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য নিলফুর আনজুমের রাজনীতি করেন বলে স্থানীয় মানুষের ভাষ্য। মামলার এক নম্বর আসামি বিএনপি নেতা ও সাবেক উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আহাম্মদ তায়েবুর রহমান।
ওই মামলায় এক নম্বর আসামিসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তারের কথা জানিয়েছেন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হাসান আল মামুন। মামলায় ইউপির চেয়ারম্যানকে আসামি করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘মামলা হয়েছে। তদন্ত হবে। ঘটনার সঙ্গে যাদের সম্পৃক্ততা আছে, তদন্ত করে পরে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মামলার সময় আমি ছিলাম না।’
মামলার পর গ্রেপ্তার আতঙ্কে কলতপাড়া এলাকার পুরুষেরা বাড়িতে তেমন থাকছেন না। গতকাল দুপুরে কলতাপাড়া বাজারে গিয়ে দেখা যায়, বেশ কিছু দোকানপাট বন্ধ। পুলিশের হয়রানির ভয়ে সেগুলো বন্ধ রাখা হয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় কয়েকজন বলেন, পুলিশের গুলিতে তিনজন মারা যাওয়ার দৃশ্য দেখে এলাকার মানুষ সেটির প্রতিবাদ করেছিলেন। এখন এলাকার সবাই গ্রেপ্তারের ভয়ে আছেন।
লাইলী বেগম নামের এক নারী বলেন, ‘এলাকার সবাই এখন ভয়ে আছি। রাতের বেলায় ঘুমালেও জেগে থাকি—আমাদের ছেলেরা, বোনের পোলাদের কারে কখন ধরে নিয়ে যায়!’