হিমাগার পর্যায়ে কঠোর তদারকি না থাকায় বাড়ছে আলুর দাম
রংপুরে চাষিদের কাছ থেকে ২৩ টাকা কেজি দরে আলু কিনে তা হিমাগারে মজুত করেন ব্যবসায়ীরা। বস্তা কেনা, পরিবহন ও শ্রমিক খরচ ও হিমাগার ভাড়ায় প্রতি কেজিতে আরও খরচ হয়েছে ৮ টাকা ১০ পয়সা। সব মিলিয়ে ব্যবসায়ীদের প্রতি কেজিতে খরচ পড়েছে ৩১ দশমিক ১০ পয়সা। অথচ সেই আলু এখন খুচরা বাজারে প্রতি কেজি ৭০–৭৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর হিমাগারে বিক্রি হচ্ছে ৬৫ টাকায়। আলুর দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ায় সাধারণ ক্রেতারা বিপাকে পড়েছেন।
হিমাগার মালিক, পাইকারি ব্যবসায়ী ও কয়েকজন সাধারণ ক্রেতা বলেন, আলুর দাম অযৌক্তিকভাবে বেড়ে যাওয়ার পেছনে অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট, বিশেষ করে হিমাগারের আলু মজুতদারেরা দায়ী। এ ছাড়া জেলায় বাজার নিয়ন্ত্রণে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের গঠিত বিশেষ টাস্কফোর্স কমিটি, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও জেলা প্রশাসন নিয়মিত অভিযান না চালানোয় এবং তাঁরা কঠোর ব্যবস্থা না নেওয়ায় আলুর মজুতদারেরা অবাধে দাম বাড়ানোর সুযোগ পেয়েছেন। এ ছাড়া হিমাগারে আলুর মজুত কমে যাওয়ার কারণে দামে প্রভাব পড়েছে।
রংপুর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রবিউল ফয়সাল মুঠোফোনে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কারণে আলুর দাম বেড়ে যাওয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, ‘আলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ওই ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে অভিযান চলছে। সাধারণ ক্রেতাদের স্বার্থে গত বৃহস্পতিবার (১৪ নভেম্বর) দুপুর থেকে রংপুর জেলা স্কুলের সামনে ৪৫ টাকা কেজি দরে আলু বিক্রি করা হচ্ছে।’
কৃষি বিপণন অধিদপ্তর রংপুর জেলা কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ১২ নভেম্বর পর্যন্ত জেলার ৪০ হিমাগারে ১২ হাজার ৫২৪ টন খাবার আলু এবং ৬২ হাজার ৩৪৪ টন বীজ আলু মজুত ছিল।
কিন্তু ১৪ নভেম্বর দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত প্রথম আলোর রংপুরের বদরগঞ্জ ও রংপুর প্রতিনিধি ৪০ হিমাগারের মধ্যে ৩৭ হিমাগারের ব্যবস্থাপকের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলে আলুর প্রকৃত মজুতের তথ্য পেয়েছেন। হিমাগারের ব্যবস্থাপকেরা জানিয়েছেন, ১৪ নভেম্বর বিকেল পর্যন্ত ৩৭ হিমাগারেই ১৫ হাজার ৪৫৮ টন খাবার আলু এবং ৪২ হাজার ৪৫০ টন বীজ আলু মজুত ছিল।
আলুচাষিরা জানান, গত মৌসুমে তাঁদের কাছ থেকে ব্যবসায়ীরা প্রতি কেজি আলু ২৩ টাকায় কিনেছেন। গত মার্চে সেই আলু হিমাগারে রেখে বর্তমানে গড়ে পাইকারি প্রতি কেজি ৬৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। খুচরা বাজারে সেই আলু বিক্রি হচ্ছে ৭০ টাকায়। দাম বেড়ে যাওয়ায় অনেক চাষিও আলু কিনে খেতে পারছেন না।
বদরগঞ্জের আমরুলবাড়ি গ্রামের আলুচাষি আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘গত ফেব্রুয়ারি মাসোত আলু তুলিয়া ভূঁই থাকি বেচাচি ২১-২২ টাকা কেজি। এ্যালা তাক বাজারোত খুচরা বেচাওচে ৭০ টাকায়। আবাদ করা আলু হামরায় কিনে খাবার পাওচি না।’
তারাগঞ্জের মেনানগর গ্রামের চাষি ইয়াছিন আলী বলেন, ‘৫০ লাখ টাকার আলু কিনি স্টোরোত থুইয়া আট মাস পরে তাক বেচাওচে এক কোটি টাকার ওপরে। টাকাওয়ালার টাকা হইতে সময় নাগে! ওরা (ব্যবসায়ীরা) খাওচে গোস্ত–মাছ। হামরা ডাইল–ভর্তা–ভাত খাবার পাওচি না।’
আলুর অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির বিষয়ে জেলার অন্তত ৩০ জন আলুচাষি, ২০ জন খুচরা ব্যবসায়ী, কৃষি বিপণন ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সাত কর্মকর্তা, ৩৭টি হিমাগারের ৩৭ জন ব্যবস্থাপকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত মৌসুমে জমি থেকে তোলার পরেই চাষিদের হাতবদল হয়ে ব্যবসায়ী চক্র আলু কবজায় নিয়ে হিমাগারে রেখে বাজারে সংকট সৃষ্টি করে। স্থানীয় প্রশাসনও তাঁদের বিরুদ্ধে তেমন ব্যবস্থা নিতে পারেননি। বর্তমানে জেলার ৪০ হিমাগারে খাবার আলুর মজুতও কমে এসেছে। এ কারণে এবার আলুর বাজার চড়া।
আলু কিনে হিমাগারে রেখেছি। দাম বেড়েছে, বিক্রি করছি। লসের ভাগ কেউ নেয় না, লাভের দিকে চোখ পড়ে সবার। এখানে সিন্ডিকেট কিংবা অপরাধের কিছু নেই। সবাই তো নিজের অধিক লাভটা খুঁজবে, এটাই স্বাভাবিক।
তারাগঞ্জের বালাবাড়ি গ্রামের আলু ব্যবসায়ী বাবু মিয়া বলেন, তিনি ৩০০ বস্তা আলু কিনে হিমাগারে রেখেছিলেন। সব মিলিয়ে প্রতি বস্তায় (৫০ কেজি) খরচ পড়েছিল ১ হাজার ৫৫০ টাকা। বিক্রি করেছেন বস্তাপ্রতি ৩ হাজার ১০০ টাকা। এবার দাম ভালো। কিন্তু ২০২০ ও ২০২১ সালে আলু কিনে হিমাগারে রেখে ভাড়াটাও ওঠেনি।
তারাগঞ্জের বড় আলুচাষি ও ব্যবসায়ী ইসরাফিল হোসেন বলেন, ‘আলুত যখন লস হইছেলো, তখন কান্দিয়া বেড়াছি। সরকার সহযোগিতা করে নাই। এবার দাম বাড়ছে, সেটা নিয়া কত কথা হওচে। মোর তিন হাজার বস্তা আলু স্টোরোত আছলো। তাক বেচাইতে আছি।’
বেশি দামে আলু বিক্রির বিষয়ে জানতে চাইলে গঙ্গাচড়া উপজেলার আলু ব্যবসায়ী আক্তারুল ইসলাম বলেন, ‘আলু কিনে হিমাগারে রেখেছি। দাম বেড়েছে, বিক্রি করছি। লসের ভাগ কেউ নেয় না, লাভের দিকে চোখ পড়ে সবার। এখানে সিন্ডিকেট কিংবা অপরাধের কিছু নেই। সবাই তো নিজের অধিক লাভটা খুঁজবে, এটাই স্বাভাবিক।’
ব্যবসায়ীরা প্রতি কেজি আলু চাষিদের কাছে ২২-২৩ টাকা দরে কিনে হিমাগারে রাখলেও লিখিত কোনো প্রমাণ মেলে না। অভিযান পরিচালনাকালে সেই সুযোগ কাজে লাগায় ব্যবসায়ী চক্র।
জেলায় বাজার নিয়ন্ত্রণে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের গঠিত বিশেষ টাস্কফোর্স কমিটিতে থাকা ছাত্র প্রতিনিধি তৌফিক আহমেদ বলেন, ‘হিমাগার ও আলুর খুচরা বাজারে অভিযান চালিয়ে ব্যবসায়ীদের জরিমানা করা হয়েছে। কিন্তু ব্যবসায়ী চক্রের সঙ্গে পেরে ওঠা যাচ্ছে না। ব্যবসায়ীরা প্রতি কেজি আলু চাষিদের কাছে ২২-২৩ টাকা দরে কিনে হিমাগারে রাখলেও লিখিত কোনো প্রমাণ মেলে না। অভিযান পরিচালনাকালে সেই সুযোগ কাজে লাগায় ব্যবসায়ী চক্র। তখন তাঁরা (ব্যবসায়ীরা) চাষি পর্যায়ে বেশি দামে আলু কেনাসহ পরিবহন খরচ বেশি পড়ার কথা বলেন। এ ক্ষেত্রে বিশেষ টাস্কফোর্স কিংবা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের তেমন কিছু করার থাকে না। এ কারণে আলুসহ বাজার নিয়ন্ত্রণে অভিযান চালানো হলেও সুফল আসছে না।’
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর রংপুর জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘গত এক সপ্তাহে ভোক্তা অধিদপ্তরের জেলা কার্যালয় ও জেলা বিশেষ টাস্কফোর্স কমিটি আলুর বাজার ও হিমাগারে ৯টি অভিযান পরিচালনা করে ১০টি প্রতিষ্ঠানকে ১ লাখ ৯০ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করেছে। আমরা নিয়মিত বাজার মনিটরিং, হিমাগার পরিদর্শনসহ বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করছি।’