ম্যাডাম বলতেন, ‘আমার স্কুলের প্রত্যেকটা মেয়ে একেকটা ফুল আর স্কুলটা ফুলের বাগান’
কিশোরগঞ্জ শহরের সরযূ বালা (এসভি) সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের ফটকে একটি শোক ব্যানার। পাশের আরেকটি শোক ব্যানারে লেখা, ‘কী করে ভুলিব তোমাকে মা, রাখিব সদায় মোনাজাতে’। ব্যানারটি টানানো হয়েছে প্রয়াত প্রধান শিক্ষক শাহনাজ কবীরের (৫৩) জন্য। যাঁর জ্ঞান ও শিক্ষার আলোয় আলোকিত পুরো বিদ্যালয়।
শিক্ষকের মর্যাদা অক্ষুণ্ন রাখতে প্রতিবছর ৫ অক্টোবর পালন করা হয় বিশ্ব শিক্ষক দিবস। এই দিনটিতেই অর্থাৎ আগামীকাল বৃহস্পতিবার দেশসেরা এ শিক্ষকের নিথর দেহ নিয়ে আসা হবে তাঁর প্রিয় বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে। গত রোববার দুপুরে ভারতের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। তিনি দীর্ঘদিন ধরে ক্যানসারে আক্রান্ত ছিলেন।
আজ বুধবার দুপুরে বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, প্রধান শিক্ষকের কার্যালয়ের দরজা লাগানো। দায়িত্বরত জ্যেষ্ঠ শিক্ষক ফেরদৌসী আক্তার খানম, শিক্ষক মো. জামাল উদ্দিনসহ কয়েকজন শাহনাজ কবীরের লাশ বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে আনার বিষয়ে কথা বলছিলেন। তাঁদের প্রিয় অভিভাবককে শেষবারের মতো দেখার জন্য বিদ্যালয়ের মাঠে শামিয়ানা টাঙানোসহ প্রয়োজনীয় কাজ করা হচ্ছে।
জ্যেষ্ঠ শিক্ষক ফেরদৌসী আক্তার বলেন, প্রায় সপ্তাহ দুয়েক আগে বড় আপা শাহনাজ কবীরের সঙ্গে তাঁর কথা হয়। তিনি নিজের বিষয়ে কথাবার্তা তেমন একটা না বলে শুধু বিদ্যালয়ের খোঁজখবর নিয়েছেন। ক্যানসারে আক্রান্ত থাকলেও যতক্ষণ পর্যন্ত বড় আপার চেতনা কাজ করেছে, ততক্ষণই বিদ্যালয়ের খোঁজখবর রাখতেন।
তিনি আরও বলেন, ‘আপা গত জুন মাসের ২২ তারিখ ক্যানসারের চিকিৎসা করাতে ভারতে গিয়েছিলেন। ২১ জুন তিনি সর্বশেষ বিদ্যালয় এসেছিলেন। বের হয়ে যাওয়ার আগে আমাদের সবার কাছে বিদায় ও দোয়া চেয়েছেন। আমরা লক্ষ্য করলাম আপা গেট থেকে বের হয়ে রাস্তায় গাড়িতে যাওয়ার সময় মাথা বের করে বিদ্যালয়ের দিকে কাঁদো কাঁদো চেহারায় তাকিয়ে আছেন। ভেজা চোখ মুছতে মুছতে তিনি বিদায় নেন।’
গণিত বিষয়ের জ্যেষ্ঠ শিক্ষক মো. জামাল উদ্দিন বলেন, একটি বিদ্যালয়ে মূল দুটি বিষয়—আর্থিক ও একাডেমিক। শাহনাজ আপা স্বচ্ছতা ও দক্ষতার সঙ্গে বিদ্যালয় পরিচালনা করেছেন। পড়ালেখার বিষয়ে কোনো রকম ছাড় না দেওয়ার জন্য বিদ্যালয়টি আজ জেলায় সর্বোচ্চ পর্যায়ে আছে। টাকার অভাবে কোনো শিক্ষার্থী কষ্ট করলে তাঁদের অর্থ দিয়ে সহায়তা করেছেন।
দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী ফাহমিদা হক বলে, ‘ম্যাডাম অনেক ভালো ছিলেন। বিদ্যালয়টাকে নিয়মের মধ্যে রাখতেন। আমাদের যেমন কড়া শাসন করতেন, তেমনি সোহাগও করতেন।’
অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী উম্মে হুমাইদা বলে, তাদের ম্যাডাম সব সময় বলতেন, ‘আমার স্কুলের প্রত্যেকটা মেয়ে একেকটা ফুল আর স্কুলটা ফুলের বাগান।’ তারা ম্যাডামের রুহের মাগফিরাত কামনা করেন।
ভারতে ক্যানসারের চিকিৎসা চলাকালে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে শেষ বার্তায় তিনি লিখে যান, ‘প্রিয় মেয়েরা আমার, ...আমি প্রতিদিনই তোমাদের খোঁজখবর নেই। কবে কী টিফিন দেওয়া হচ্ছে তাও জানি। শুধু আমাকে তোমরা দেখতে পারছ না।...ভারতে আসার আগে সপ্তম শ্রেণির কয়েকজন ছাত্রীর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলেছিলাম। একটা মেয়ে এসে বলল, ম্যাডাম কাঁদবেন না। বলে সেও কাঁদতে শুরু করে দিল। আর একটা মেয়ে বলল, ম্যাডাম আপনাকে ছাড়া স্কুল ভালো লাগে না। এটাই আমার বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা। কথাগুলো আমাকে শক্তি দেয়।’
নিজের কাজের স্বীকৃতি হিসেবে শাহনাজ কবীর পেয়েছেন বহু পুরস্কার। ২০২০ সালে আইপিডিসি-প্রথম আলো প্রিয় শিক্ষক সম্মাননা পান। এর আগে ২০১৯ সালে মাধ্যমিক পর্যায়ে দেশের সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধান ‘প্রধান শিক্ষক’ নির্বাচিত হন তিনি। প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পাওয়ার পর ২০১২ ও ২০১৩ সালে টানা দুবার এসএসসি পরীক্ষায় ফলাফলে সরযূ বালা উচ্চবিদ্যালয় জেলার সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মর্যাদা লাভ করে।
পরিবারের সদস্যরা বলেন, ১৯৭০ সালের ১৮ মার্চ হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং উপজেলার কুমড়ি-দুর্গাপুর গ্রামে শাহনাজ কবীর জন্মগ্রহণ করেন। বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা শামছুল কবীর ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা। মা সুফিয়া কবীর গৃহিণী। ১৯৯৭ সালে ঐতিহ্যবাহী নোয়াখালী জিলা স্কুলে ইংরেজি শিক্ষক হিসেবে তাঁর বর্ণাঢ্য শিক্ষকতা জীবনের শুরু হয়। ২০০৬ সালের ৬ মার্চ তিনি সরযূ বালা সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে যোগদান করেন।
তাঁর ছোট ভাই মোহাম্মদ শফিকুল কবীর জানান, তাঁর বোনের লাশ বুধবার দুপুরে ভারত থেকে ঢাকা এসেছে। আগামীকাল বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় তাঁর প্রিয় প্রতিষ্ঠান সরযূ বালা উচ্চবিদ্যালয়ে লাশ রাখা হবে। বাদ জোহর কিশোরগঞ্জ জেলা শহরের ঐতিহাসিক শহিদী মসজিদে জানাজা শেষে শ্বশুরবাড়ি ময়মনসিংহের গৌরীপুরের কলতাপাড়া এলাকায় তাঁকে দাফন করা হবে।
পরিবারের সদস্যরা বলেন, শাহনাজ কবীর ক্যানসার ও ভালোবাসা নামে আত্মজীবনীমূলক একটি বই লিখেছেন। তাঁর স্বামী রফিকুল ইসলাম একজন উপসচিব। শাহনাজ কবীরের দুই সন্তান। বড় মেয়ে তাসনিম ইসলাম বাজিতপুরের জহুরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের ছাত্রী আর ছোট মেয়ে তাহসিন ইসলাম সরযূ বালা উচ্চবিদ্যালয় থেকে এবার এসএসসি পরীক্ষায় পাস করেছে।