চট্টগ্রাম নগরের অভিজাত জিইসি ওআর নিজাম রোড এলাকায় দুই কোটি টাকা মূল্যের দুটি ফ্ল্যাট। নগরের একটি শপিং মলে তিনটি দোকান। সাড়ে ২২ লাখ টাকা দামের প্রাইভেট কার। ব্যাংক হিসাবে কোটি টাকা। এসব সম্পত্তির মালিক আনোয়ারা বেগম নামের এক গৃহিণী। তাঁর স্বামী নজরুল ইসলাম ভূমি কার্যালয়ের (বরখাস্ত) একজন শিকলবাহক (চেইনম্যান)। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) হিসাব অনুযায়ী চাকরিজীবনে (১৯৯৪ থেকে ২০১৯) বেতনের অর্ধেক খরচ বাদ দিয়ে তাঁর কাছে থাকার কথা ১৪ লাখ ৮১ হাজার টাকা।
নজরুল, তাঁর স্ত্রী আনোয়ারা বেগম, শ্যালিকাসহ সাতজনকে আসামি করে গতকাল সোমবার চট্টগ্রাম আদালতে অভিযোগপত্র জমা দিয়েছে দুদক। অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়, নজরুল ও তাঁর স্ত্রী ১১ কোটি ২১ লাখ ৬৮ হাজার টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন। সাতজন আসামির মধ্যে বাকি অন্যরা হলেন শ্যালিকা কোহিনুর আকতার, দোকান কর্মচারী শাহাদাত হোসেন, আত্মীয় জামাল উদ্দিন, সামসুন নাহার চৌধুরী ও শামসুল আলম। তাঁদের মধ্যে নজরুল জামিনে। অন্যদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির জন্য দুদকের পক্ষ থেকে আদালতে আবেদন করা হয়েছে।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুদক চট্টগ্রামের উপপরিচালক মো. আতিকুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, চেইনম্যান নজরুল, তাঁর স্ত্রী, শ্যালিকা, দোকান কর্মচারী, আত্মীয়সহ সাতজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র আদালতে দেওয়া হয়েছে। ‘ঘুষ ও দুর্নীতির’ মাধ্যমে তাঁরা এসব সম্পদের মালিক হয়েছেন।
২০১৯ সালের ৭ নভেম্বর নজরুল ইসলাম ও জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের অফিস সহকারী তছলিম উদ্দিন নগরের চিটাগাং শপিং কমপ্লেক্সে তাঁর স্ত্রীর মালিকানাধীন দোকানে ধরা পড়েন দুদকের হাতে। ওই সময় নজরুলের কাছে পাওয়া যায় প্রায় ৯১ লাখ টাকার চেক ও নগদ সাড়ে ৭ লাখ টাকা। এ ঘটনায় দুদক মামলা করে। সাড়ে চার বছর তদন্ত শেষে দুদক এই মামলার অভিযোগপত্র দেয়।
নজরুল ইসলাম একসময় চট্টগ্রাম জেলা ভূমি অধিগ্রহণ কার্যালয়ের শিকলবাহক (চেইনম্যান) ছিলেন। ২০১৭ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি আকস্মিক পরিদর্শনে গিয়ে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে তাঁকেসহ তিনজনকে তাৎক্ষণিক বদলির নির্দেশ দেন তৎকালীন ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী। এরপর তাঁর কর্মস্থল হয় ফটিকছড়ি উপজেলা পরিষদে।
দুদক সূত্র জানায়, ১৯৯৪ সালে ১ হাজার ৮০০ টাকা বেতনে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী হিসেবে চাকরিতে ঢোকেন নজরুল। দুদকের হাতে ধরা পড়ার আগে ২০১৯ সালের ৭ নভেম্বর পর্যন্ত তিনি বেতন–ভাতা পান ২৯ লাখ ৬২ হাজার ৮৬৬ টাকা। দুই ছেলের পড়াশোনা, সাংসারিক খরচসহ অর্ধেক বাদ দিয়ে তাঁর কাছে থাকার কথা ১৪ লাখ ৮১ হাজার ৪৩৩ টাকা। দুদক সূত্রের ভাষ্য, নজরুলের বড় ছেলে সম্প্রতি লন্ডন থেকে এমবিএ করেছেন। ছোট ছেলে চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এমবিএ পড়ছেন। দুই ছেলের লেখাপড়া, চিকিৎসা ও পারিবারিক ব্যয় বাদ দিলে তাঁর কোনো সঞ্চয় থাকার কথা নয়।
দুদকের তদন্তে উঠে আসে, নজরুল তাঁর স্ত্রী আনোয়ারা বেগমের নামে নগরের জিইসি ওআর নিজাম রোড এলাকায় ২ হাজার ৭০ বর্গফুটের ১ কোটি ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকার একটি এবং একই এলাকায় ১ হাজার ৬২০ বর্গফুটের ১ কোটি ২ লাখ ৩৪ হাজার টাকার মোট দুটি ফ্ল্যাট রয়েছে। নজরুলের নামে গ্রামের বাড়ি হাটহাজারীতে রয়েছে ৮২ লাখ ৪৯ হাজার টাকা দামের একটি তিনতলা বাড়ি।
নগরের ষোলোশহর এলাকার চিটাগাং শপিং কমপ্লেক্সের দ্বিতীয় তলায় ৮৫ লাখ টাকা দামের একটি, একই তলায় ৬ লাখ ৫০ হাজার টাকার আরেকটি এবং একই মার্কেটের প্রথম তলায় ৩ লাখ ৭০ হাজার টাকার আরেকটিসহ তিনটি দোকান রয়েছে নজরুল ও তাঁর স্ত্রীর নামে। এ ছাড়া স্ত্রীর নামে সাড়ে ২২ লাখ টাকার একটি প্রাইভেট কার রয়েছে।
নজরুলের শ্যালিকা কোহিনুর আক্তারের ব্যাংক হিসাবে ২ কোটি ২ লাখ ৫৫ হাজার টাকা, দোকান কর্মচারী শাহাদাত হোসেনের হিসাবে ৩ কোটি ১৯ লাখ ৭৬ হাজার টাকা, আত্মীয় শামসুল আলমের হিসাবে ৪ কোটি ৯০ লাখ টাকা, শামসুন নাহারের হিসাবে ৩ কোটি টাকা ও জামাল উদ্দিনের হিসাবে ৭১ লাখ ২২ হাজার টাকার তথ্য পায় দুদক। অথচ কোহিনুর ও শামসুন নাহার গৃহিণী। অন্যরা ব্যবসায়ী দাবি করলেও তাঁদের ব্যবসার কোনো কাগজপত্র দেখাতে পারেননি দুদককে। জানা গেছে, এই টাকা বিভিন্ন সময়ে নজরুল ইসলাম তাঁর আত্মীয়স্বজনের অ্যাকাউন্টে পাঠিয়েছেন।
দুদক জানায়, মামলায় শুরুতে নজরুল ও তাঁর স্ত্রীকে আসামি করা হলেও তদন্তে অন্য পাঁচজনের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়। তাঁরা এসব অর্থ স্থানান্তর, হস্তান্তর ও রূপান্তর করে স্বামী–স্ত্রীকে সহযোগিতা করায় আসামি করে দুদক। শামসুল আলম আসামি আনোয়ারা বেগমের নিকটাত্মীয়। তাঁর মেসার্স কোয়ালিটি প্রোডাক্টস নামের একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ছিল দাবি করলেও তদন্তকালে দুদককে কোনো তথ্য–প্রমাণ দেখাতে পারেননি।
ভুক্তভোগীরা জানান, সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পের অধিগ্রহণ করা ভূমির ক্ষতিপূরণের টাকা পাইয়ে দিয়ে গ্রাহকদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের কমিশন নিতেন নজরুল। তিনি ফটিকছড়িতে কর্মরত থাকলেও চট্টগ্রাম এলএ শাখা ছিল তাঁর হাতের মুঠোয়।