আসামিকে নিয়ে সংসার করছেন বাদী, ছেলে হত্যার বিচার নিয়ে শঙ্কায় মা
স্বামীর সঙ্গে ২০০৯ সালে বিবাহবিচ্ছেদের পর আয়েশা সিদ্দিকা ওরফে স্বপ্না ছেলে আরাফাতকে নিয়ে বাবার বাড়িতে চলে আসেন। সাত বছর পর ছেলের বয়স যখন ১৬ হলো তখন হত্যার শিকার হয় সে। মামলা করেন আরাফাতের বাবা হযরত আলী তালুকদার। তদন্তে বের হয়ে আসে, হযরত আলীর আরেক স্ত্রী জমিলা খাতুন এই হত্যার পরিকল্পনাকারী ও অর্থদাতা। এরপরও থমকে আছে হত্যার বিচার। জামিনে মুক্ত সব আসামি।
সন্তান হত্যার বিচার চেয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন আয়েশা সিদ্দিকা। তাঁর অভিযোগ, আসামি জমিলা আর বাদী হযরত আলী তালুকদার মিলে গেছেন। এক ঘরে বসবাস করছেন তাঁরা। বাদী তাঁর স্ত্রীকে রক্ষার জন্য নানা অপচেষ্টা শুরু করেছেন। তাই ছেলে হত্যার বিচার পাবেন কি না, তা নিয়ে শঙ্কায় আছেন আয়েশা সিদ্দিকা।
মামলা সূত্রে জানা যায়, কালিহাতী উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য হযরত আলীর প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর আয়েশা সিদ্দিকাকে ১৯৯৮ সালে বিয়ে করেন। সেই ঘরে আরাফাত তালুকদার ওরফে সংগ্রামের জন্ম হয়। ২০০৯ সালে হযরত আলীর সঙ্গে আয়েশার বিবাহবিচ্ছেদ হয়। আয়েশা ছেলেকে নিয়ে তাঁর বাবার বাড়ি কালিহাতী উপজেলার কদিমহামজানী গ্রামে চলে যান। সেখানেই তিনি বসবাস করতেন। ২০১৬ সালের ১১ জানুয়ারি সন্ধ্যায় আয়েশার ছেলে আরাফাতকে (১৬) এলাকার কয়েকজন ডেকে নিয়ে যায়। রাতে সে বাড়ি ফেরেনি। পরদিন সকালে ওই গ্রামের এক পুকুরে আরাফাতের ভাসমান লাশ পাওয়া যায়। ২০ জানুয়ারি আরাফাতের বাবা হযরত আলী তালুকদার কালিহাতী থানায় হত্যা মামলা করেন। মামলায় চারজনকে আসামি করা হয়।
মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় গোয়েন্দা পুলিশকে। গোয়েন্দা পুলিশ ২০১৭ সালের আগস্টে কদিমহামজানী গ্রামের সরোয়ার নামের একজনকে গ্রেপ্তার করে। তিনি এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেন। আরাফাতকে হত্যার জন্য একই গ্রামের শফি কামাল সিদ্দিকী অর্থ দিয়েছিলেন বলে জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশকে জানান সরোয়ার। পরে শফি কামালকেও গ্রেপ্তার করে পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি জানান, আরাফাত তার বাবার সম্পত্তির উত্তরাধিকার হবেন। তাই হযরত আলীর তৃতীয় স্ত্রী জমিলা খাতুন আরাফাতকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। আরাফাতকে হত্যার জন্য শফি কামালকে ২ লাখ টাকাও দেন জমিলা।
সরোয়ার ও শফি কামাল হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে ২০১৭ সালের ২৬ আগস্ট আদালতে জবানবন্দি দেন। পরে পুলিশ হযরত আলী তালুকদারের তৃতীয় স্ত্রী জমিলা খাতুনকে গ্রেপ্তার করে।
তদন্ত শেষে ২০১৮ সালের ১৯ জুন জেলা গোয়েন্দা পুলিশের উপপরিদর্শক সবেদ আলী আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন। এতে জমিলা খাতুনসহ ছয়জনকে অভিযুক্ত করা হয়। টাঙ্গাইলের বিশেষ আদালতে মামলাটি বিচারাধীন রয়েছে। আসামিরা সবাই জামিনে মুক্ত রয়েছেন।
আদালত সূত্র জানায়, আদালতে মামলার অভিযোগ গঠনের পর সাক্ষ্য গ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু হয়। তখন মামলার বাদী হযরত আলী নানা অজুহাতে সাক্ষ্য দেওয়া থেকে বিরত থাকেন। মামলাটি অন্য জেলায় স্থানান্তরের জন্য উচ্চ আদালতে আবেদন করেন। দুই দফায় এক বছর মামলার কার্যক্রম উচ্চ আদালতের আদেশে স্থগিত থাকে।
আরাফাতের মা আয়েশা সিদ্দিকা বলেন, ‘মামলার বাদী হযরত আলী তালুকদার ও আসামি জমিলা খাতুন একই বাড়িতে বসবাস করছেন। তাই জমিলাকে রক্ষার জন্য বাদী কালক্ষেপণ করছেন। সাক্ষীরা যাতে নির্বিঘ্নে সাক্ষ্য দিতে না পারেন, সে জন্য বাদী মামলাটি অন্য জেলার আদালতে স্থানান্তর করতে চেয়েছিলেন। আমি আমার ছেলে হত্যার বিচার চাই।’
হযরত আলী তালুকদারের ভাষ্য, যে আদালতে মামলাটি বিচারাধীন, সেখানে তিনি ন্যায়বিচার পাবেন না। এ আশঙ্কায় অন্য জেলার আদালতে মামলাটি স্থানান্তরের চেষ্টা করেছিলেন। তিনি বলেন, আসামি জমিলা তাঁর স্ত্রী। তাই তাঁরা একসঙ্গে বসবাস করেন। তবে যে-ই আসামি হোক তিনি সবার শাস্তি চান।
মামলার বিষয়ে টাঙ্গাইল আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) এস আকবর খান বলেন, মামলাটি অন্য জেলায় স্থানান্তরের জন্য বাদী উচ্চ আদালতে আবেদন করেছিলেন। সে জন্য আদালতের নির্দেশে এক বছর এর কার্যক্রম বন্ধ ছিল। এখন মামলাটি চলতে আর কোনো বাধা নেই। বাদী সাক্ষ্য দেওয়াসহ বিচার কার্যক্রমে যাতে রাষ্ট্রপক্ষকে সহায়তা করে, সে জন্য দৃষ্টি রাখা হবে। বাদী অসহযোগিতা করলে বাদী পরিবর্তনের জন্য আদালতে আবেদন করা হবে।