রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
ছাত্রত্ব শেষে সান্ধ্য কোর্স, ভাষা কোর্সে ভর করে ছাত্রলীগের নেতৃত্বে আসতে চান তাঁরা
নিয়মিত মাস্টার্স (স্নাতকোত্তর) শেষ করে কেউ ভর্তি হয়েছেন সান্ধ্য মাস্টার্স কোর্সে। কেউ আবার ভাষা শিক্ষার ‘শর্ট কোর্সে’। কেউ কেউ পড়াশোনা শেষ না করতে পেরে ঝরে পড়েছেন (ড্রপআউট) বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এমন অনিয়মিত ছাত্ররা আসতে চান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নেতৃত্বে; যদিও ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, অছাত্রদের নেতৃত্বে আসার সুযোগ নেই।
দীর্ঘ প্রায় সাড়ে ছয় বছর পর কাল সোমবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের ২৬তম বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। এই সম্মেলনের মাধ্যমে সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক পদে আসতে ছাত্রলীগের ৯৪ জন কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে জীবনবৃত্তান্ত জমা দিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে প্রায় এক ডজন নেতার নাম ক্যাম্পাসে বেশি আলোচিত হচ্ছে। তাঁদের বেশির ভাগের ছাত্রত্ব শেষ হয়েছে অনেক আগেই। বিভিন্ন সময়ে ক্যাম্পাসের অনেক বিতর্কিত কর্মকাণ্ডেও এসেছে কারও কারও নাম।
বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক শাখার ডেপুটি রেজিস্ট্রার এ এইচ এম আসলাম হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা বিভিন্ন সান্ধ্যকালীন কোর্স ও শর্ট কোর্সে ভর্তি আছেন তাঁদের নিয়মিত শিক্ষার্থী বলার সুযোগ নেই। তাঁরা আবাসিক হল, বাস ব্যবহার ও সমাবর্তনে অংশ নিতে পারেন না।
দীর্ঘ প্রতীক্ষার সম্মেলনকে ঘিরে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের মধ্যে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরেছে। ক্যাম্পাসের গুরুত্বপূর্ণ চত্বরগুলোয় সাঁটানো হয়েছে পদপ্রত্যাশী নেতাদের নামে ব্যানার, ফেস্টুন ও সাইনবোর্ড। মিটিং-মিছিল ও শোডাউন নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন তাঁরা। পদে আসতে ধরনা দিচ্ছেন কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় প্রভাবশালী নেতাদের দরবারে। শীর্ষ নেতৃত্বে কে আসবেন, এ নিয়ে ক্যাম্পাসের সব মহলে চলছে আলোচনা।
পদপ্রত্যাশীদের জীবনবৃত্তান্ত, একাডেমিক শাখা, সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও ছাত্রলীগ সূত্রে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটির প্রশিক্ষণ–বিষয়ক সম্পাদক আসাদুল্লাহ-হিল-গালিব আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। প্রথম বর্ষে উত্তীর্ণ হলেও দ্বিতীয় বর্ষ আর টপকাতে পারেননি। পরে ড্রপআউট হয়ে ছাত্রত্ব হারিয়েছেন তিনি। এরপরও মাদার বখশ হলে থাকছেন। অভিযোগ আছে, ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ দেখিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সন্ধ্যাকালীন মাস্টার্স কোর্সে ভর্তি হয়েছেন তিনি। জানতে চাইলে আসাদুল্লাহ-হিল-গালিব বলেন, ‘এসব অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা। আমরা বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীরা এসব ছড়াচ্ছে।’
আরেক ‘ড্রপআউট’ শিক্ষার্থী হলেন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান। তিনিও সম্মেলনে পদপ্রত্যাশীদের একজন। তিনি সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হয়েছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে আবাসিক হলে সিট–বাণিজ্য, ক্যাম্পাসে চাঁদাবাজি ও দোকান ভাঙচুরের মতো অভিযোগ রয়েছে। ছাত্রত্ব না থাকলেও বর্তমানে তিনি ভর্তি রয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ইংলিশ অ্যান্ড আদার ল্যাঙ্গুয়েজেজের একটি কোর্সে। অভিযোগের বিষয়ে মেহেদী হাসান বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। আমার সঙ্গে যারা রাজনীতি করে, তাদের কিছু অপকর্মের অভিযোগ আমার দিকে এসেছে। তবে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ঘটনায় জড়িত নই।’
বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি মেসবাহুল ইসলাম ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি ২০১৯ সালে অনার্স এবং পরের বছর মাস্টার্স শেষ করেছেন। দলের মধ্যে ‘গ্রুপিং সৃষ্টি’ ও তাঁর পরিবার বিএনপি-জামায়াতপন্থী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বলে ক্যাম্পাসে প্রচার আছে। তবে মেসবাহুল ইসলাম বলেন, ‘আমার পরিবারের কেউ জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নয়।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবাশ বাংলাদেশ মাঠে কাল অনুষ্ঠেয় সম্মেলনের উদ্বোধন করবেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে থাকবেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন।
কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সদস্য সাকিবুল হাসান দীর্ঘদিন ক্যাম্পাসের রাজনীতিতে অনুপস্থিত ছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে ক্যাম্পাসে ছাত্রীদের উত্ত্যক্ত করা ও চাঁদাবাজির অভিযোগ রয়েছে। সম্প্রতি ক্যাম্পাসে ছাত্রদলের দুই নেতাকে মারধর করে আলোচনায় আসেন তিনি। সম্মেলনে পদপ্রত্যাশী সাকিবুল হাসান লোকপ্রশাসন বিভাগ থেকে ২০২০ সালে পড়ালেখা শেষ করেছেন। এ বিষয়ে জানতে তাঁর মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি ধরেননি।
সম্মেলনে পদপ্রত্যাশীদের মধ্যে আলোচিত ব্যক্তিদের একজন বর্তমান কমিটির সহসভাপতি ও মার্কেটিং বিভাগের ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী কাজী আমিনুল হক। মার্কেটিং বিভাগ থেকে ২০১৬ সালে বিবিএ ও পরের বছর এমবিএ শেষ করেছেন আমিনুল। তবে ছাত্রত্ব ধরে রাখতে একই বিভাগের সন্ধ্যাকালীন এমবিএ কোর্সে ভর্তি রয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে দলীয় কোন্দল সৃষ্টির অভিযোগ রয়েছে। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বর্তমানে মার্কেটিং বিভাগের একটি সান্ধ্য কোর্সে ভর্তি আছি। দীর্ঘদিন কমিটি না থাকায় একটি অচলাবস্থা তৈরি হয়েছিল। সেই দাবিতে বিভিন্ন সময় কথা বলাকে কেউ যদি দলীয় কোন্দল সৃষ্টি বলে, তাহলে সেটা অত্যন্ত দুঃখজনক।’
২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষের আরেক শিক্ষার্থী শাহিনুল ইসলাম সরকার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদে আছেন। এবারের সম্মেলনে পদপ্রত্যাশী এই নেতা ২০১৬ সালে অনার্স এবং ২০১৮ সালে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। তিনি ইনস্টিটিউট অব ইংলিশ অ্যান্ড আদার ল্যাঙ্গুয়েজেজের জার্মান ভাষার শর্ট কোর্সে ভর্তি রয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধেও সংগঠনে গ্রুপিং করার অভিযোগ রয়েছে। তবে অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, ‘যেহেতু দীর্ঘদিন আমাদের কমিটি হয়নি, তাই নতুন কমিটির দাবিতে আমরা বেশ কয়েকজন পদপ্রত্যাশী মিলে মিটিং-মিছিল করেছিলাম। এটা আসলে আমাদের সাংগঠনিক চর্চার মধ্যেই পড়ে।’
বর্তমান কমিটির উপধর্ম–বিষয়ক সম্পাদক ও ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের ২০১৫-১৬ সেশনের শিক্ষার্থী তাওহীদুল ইসলাম। এই বিভাগ থেকে অনার্স শেষ করেছেন তিনি। কিন্তু ছাত্রত্ব ধরে রাখতে এখনো মাস্টার্স শেষ করেননি। তাঁর বিরুদ্ধে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিরোধী রাজনীতি করে সাংগঠনিক দুর্বলতা তৈরির অভিযোগ রয়েছে। তাওহীদুল ইসলাম বলেন, ‘আমার ছাত্রত্ব আছে। আমি স্নাতক সম্পন্ন করে এখন মাস্টার্সে ভর্তি আছি।’
আরেক পদপ্রত্যাশী গণযোগাযোগ ও উন্নয়নবিষয়ক সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান। বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষের এই শিক্ষার্থী পড়ালেখা শেষ করেছেন। ছাত্রত্ব ধরে রাখতে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ইংলিশ অ্যান্ড আদার লাঙ্গুয়েজেজের একটি শর্ট কোর্সে ভর্তি রয়েছেন। মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘আমি ইনস্টিটিউট অব ইংলিশ অ্যান্ড আদার লাংগুয়েজেজের একটি শর্ট কোর্সে ভর্তি আছি।
ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কমিটি হয়ে থাকে এক বছরের জন্য। তবে অর্ধযুগেরও বেশি সময় ধরে সম্মেলন না হওয়ায় বর্তমান কমিটির অধিকাংশ নেতা-কর্মী ক্যাম্পাস ছেড়েছেন। সম্মেলনকে কেন্দ্র করে দীর্ঘদিন নিষ্ক্রিয় থাকা বেশ কয়েকজন নেতা পদে আসতে জোর তৎপরতা চালাচ্ছেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন বর্তমান কমিটির সহসভাপতি জাকিরুল ইসলাম, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ফয়েজ আহমেদ, রাজশাহী মহানগর ছাত্রলীগের সহসভাপতি অনিক মাহমুদ ও মাদার বখশ হল ছাত্রলীগের সহসভাপতি সাজ্জাদ হোসেন।
বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের বর্তমান সভাপতি গোলাম কিবরিয়া বলেন, ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্র অনুসারে বিবাহিত, অছাত্র, বয়স নেই—এমন কারও নেতৃত্বে আসার সুযোগ নেই। যাঁরা আওয়ামী পরিবারের সন্তান, দক্ষ সংগঠক, পরিশ্রমী, রাজপথের ত্যাগী সৈনিক, সংগঠনের প্রতি নিবেদিত হয়ে একাত্তরের পরাজিত শক্তি ও জামায়াত-শিবিরকে প্রতিহত করবেন, দলের নীতি-আদর্শ বজায় রাখবেন, তাঁদের নেতৃত্বে দেখতে চান।
ছাত্রলীগ সূত্রে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবাশ বাংলাদেশ মাঠে কাল অনুষ্ঠেয় এই সম্মেলনের প্রথম অধিবেশনের উদ্বোধন করবেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে থাকবেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও রাজশাহী সিটি মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি গোলাম কিবরিয়ার সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক ফয়সাল আহমেদের সঞ্চালনায় এতে প্রধান বক্তা থাকবেন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান। বিশেষ অতিথি হিসেবে থাকার কথা রয়েছে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের।