মৌলভীবাজারে সড়কে এখনো বন্যার ক্ষত
এবারের বন্যায় জেলায় সওজের ৭৫ কিলোমিটার সড়ক এবং এলজিইডির ছোট-বড় সড়কের ৪০৫ কিলোমিটার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
মাঠ বা লোকালয়ের দিকে তাকালে এখন আর অনুমান করার সুযোগ নেই, এসব জায়গায় বন্যার পানি কতটা তাণ্ডব চালিয়েছে। চারদিকে থইথই করে কত তীব্র বেগে পানির স্রোত ছুটে চলেছে। বন্যায় শুধু ফসলের ক্ষতিই করেনি, অনেক ঘরবাড়ি ও সড়ক পানির তোড়ে ভেঙে গেছে। অনেক সেতু-কালভার্ট ধসে পড়েছে। বন্যা চলে গেছে ঠিকই, কিন্তু তার ছোবলের ক্ষত এখনো মৌলভীবাজার জেলার বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। বন্যার ক্ষয়ক্ষতির চিত্র মেলে ধরে আছে সড়কগুলো।
সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগ, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ভারী বৃষ্টি ও উজান (ভারত অংশ) থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে এ বছর মৌলভীবাজার জেলায় কয়েক দফা বন্যার সৃষ্টি হয়েছে। বন্যার পানিতে সড়কগুলো তলিয়ে গিয়ে যোগাযোগব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়েছে।
সম্প্রতি জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার কমলগঞ্জ-আদমপুর সড়ক ঘুরে দেখা যায়, সড়কটির বিভিন্ন স্থানজুড়ে ছোট-বড় অসংখ্য গর্ত। সড়কের আদমপুর ইউনিয়নের ঘোড়ামারা এলাকার প্রায় আধা কিলোমিটার ক্ষত–বিক্ষত হয়ে আছে। যানবাহন চালানোর কোনো সুযোগ নেই। এক গর্ত এড়িয়ে চলতে গেলে অন্য গর্তে গাড়ির চাকা পড়ে যায়। কোথাও সড়কের পাশ ও ঢাল ধসে পড়েছে। একই রকম অবস্থা আদমপুর বাজারের দক্ষিণ পাশের সড়কের। সিএনজিচালিত অটোরিকশাচালক রণজিত সিংহ জানান, গর্তে ভরা সড়কে গাড়ি চালাতে খুব কষ্ট। হাতে ব্যথা হয়ে যায়।
কমলগঞ্জ-আদমপুর সড়কে নিয়মিত যাতায়াতকারী দৌড়বিদ ও চিকিৎসক সঞ্জীব থোঙাম। তিনি বলেন, সড়কের বিভিন্ন স্থান বন্যার আগে থেকেই কিছুটা খারাপ ছিল। বন্যা সড়কের অবস্থা একদম খারাপ করে ফেলেছে। সড়কে অনেক ভাঙা। প্রায় ৫ কিলোমিটার জায়গা মোটরসাইকেল বা সিএনজিচালিত অটোরিকশায় যেতে ১০ থেকে ১৫ মিনিটের জায়গায় আধা ঘণ্টা লাগে। সড়কের শ্রীপুর থেকে আদমপুর, ঘোড়ামারা, তিলকপুরসহ কয়েকটি স্থানে বেশি ভাঙা।
সওজ মৌলভীবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, জেলার মধ্যে বন্যায় সওজের ১৫টি সড়কের ৭৫ কিলোমিটার অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত সড়কগুলোর মধ্যে আছে রাজনগর-কুলাউড়া-জুড়ী-বড়লেখা-বিয়ানীবাজার-শ্যাওলা-চারখাই সড়ক, জুড়ী-লাঠিটিলা সড়ক, শাহবাজপুর-জলঢুপ সড়ক, বড়লেখা-শাহবাজপুর-লাতু সড়ক, জুড়ী-ফুলতলা-বটুলি সড়ক, মৌলভীবাজার-শমসেরনগর-চাতলা চেকপোস্ট সড়ক, কুলাউড়া-শমসেরনগর-শ্রীমঙ্গল সড়ক, হামরকোনা এন-২০৭ পুরাতন এলাইনমেন্ট সড়ক, জুড়ী (ক্লিবডন)-কুলাউড়া (গাজীপুর) সড়ক, কুলাউড়া-পৃথিমপাশা-হাজীপুর-শরিফপুর (লিংক টু রবিরবাজার-টিলাগাঁও) সড়ক, মৌলভীবাজার (রাজনগর)-সিলেট (বালাগঞ্জ) সড়ক, মিরপুর-শ্রীমঙ্গল-মৌলভীবাজার-শেরপুর সড়ক, মৌলভীবাজার-রাজনগর-ফেঞ্চুগঞ্জ-সিলেট সড়ক, কুলাউড়া (গাজীপুর)-জুড়ী (সাগরনাল) উপজেলা সংযোগ সড়কগুলো।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বন্যায় সওজের সড়কগুলোর যে ক্ষতি হয়েছে, তা সংস্কার ও নির্মাণে তিন স্তরের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। সে অনুযায়ী ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে চাহিদা পাঠানো হয়েছে। তার মধ্যে প্রাথমিক পর্যায়ে নিয়মিত সংস্কারের জন্য চাহিদা দেওয়া হয়েছে ১৫ কোটি টাকার। মধ্যবর্তী সংস্কারের জন্য চাওয়া হয়েছে ১২০ কোটি টাকা এবং দীর্ঘমেয়াদি স্থায়ী কাজের জন্য চাওয়া হয়েছে সাড়ে ৩০০ কোটি টাকা।
সওজের মৌলভীবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. কায়সার হামিদ বলেন, ‘বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়া সড়কগুলো বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। সেগুলো মেরামতের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে কর্মসূচি পাঠিয়েছি। কিন্তু এখনো অনুমোদন মেলেনি। নিয়মিত বিভাগীয়ভাবে রিপেয়ারিং কাজ হচ্ছে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কাজ সংস্কার বা পুননির্মাণের জন্য এখনো কোনো বরাদ্দ পাওয়া যায়নি।’
এলজিইডি মৌলভীবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, এবারের বন্যায় সারা জেলায় এলজিইডির ২২৩টি ছোট-বড় সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত প্রায় সব রাস্তা পাকা। এসব সড়কের ক্ষতিগ্রস্ত অংশের পরিমাণ হচ্ছে প্রায় ৪০৫ কিলোমিটার। এ ছাড়া বিভিন্ন সড়কের ৩৪টি সেতু-কালভার্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রাস্তাগুলো পুনরায় সংস্কার বা মেরামত করতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে ৫৩৩ কোটি টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। এলজিইডির বেশির ভাগ রাস্তাই গ্রামীণ। গ্রামের সঙ্গে উপজেলা ও জেলা সদরের সংযোগ তৈরি করেছে এসব সড়ক। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলোর মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কমলগঞ্জ-আদমপুর সড়ক ও আদমপুর-মাধবপুর-ভানুগাছ সড়ক। ধলাই নদের ভাঙনে এ দুটি সড়ক তলিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
এলজিইডি মৌলভীবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী আহমেদ আবদুল্লাহ বলেন, অনেকটি সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যে সড়কগুলো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ও বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে সেগুলো ঠিক করার জন্য ইমার্জেন্সি ভিত্তিতে ছোট ছোট কিছু স্কিম নেওয়া হয়েছে। তবে এখনো কাজ শুরু হয়নি। টেন্ডার হবে, তারপর কাজ হবে। এ ছাড়া ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ কিছু স্থানের তথ্য চেয়েছে, তা পাঠানো হয়েছে।