যে কারণে নদনদীতে ইলিশ ধরা পড়ছে না
মৌসুমের এ সময়টাতে উপকূলের নদ-নদীতে ইলিশ ধরা পড়ার কথা। কিন্তু জালে তেমন ইলিশ উঠছে না।
ইলিশসহ বিভিন্ন সামুদ্রিক মাছের সুষ্ঠু প্রজনন নিশ্চিত করতে বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরায় ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা চলছে। ১৯ মে শুরু হওয়া এই নিষেধাজ্ঞা শেষ হবে ২৩ জুলাই। ফলে সমুদ্র উপকূলের কয়েক লাখ জেলে এখন বেকার। এরই মধ্যে শুরু হয়েছে বর্ষা। মৌসুমের এ সময়টাতে উপকূলের নদ-নদীতে ইলিশ ধরা পড়ার কথা। কিন্তু জেলেরা নদ-নদীতে জাল ফেললেও তেমন ইলিশ উঠছে না। যা কিছু জাটকা উঠছে, সেগুলোর দাম অনেক বেশি।
মৎস্যসম্পদ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জালে ইলিশ না ওঠায় হতাশ হওয়ার কিছু নেই। বৃষ্টি ও নদীতে জোয়ারের চাপ ও স্রোত বাড়লে ইলিশ আসবে এবং ধরাও পড়বে। এ জন্য প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে একটু ধৈর্য ধরতে হবে।
বঙ্গোপসাগরের তীরের জেলা বরগুনার তালতলী এলাকার জেলে দুলাল মিয়া ছোট ট্রলারে নদীতে মাছ ধরেন। আক্ষেপ করে তিনি বলেন, ‘গাঙ্গে গোনে মাছ-পোনা এক্কেবারে ধুইয়্যা-মুইচ্ছা গ্যাছে।’
এ অঞ্চলের মেঘনা অববাহিকার নদ-নদী বিষখালী, পায়রা, বলেশ্বর, তেঁতুলিয়া, আন্ধারমনিক, রামনাবাদ, ইলিশা, কালাবদর, লতা, মাসকাটা, বদরটুনি, কীর্তনখোলা—এসব নদ–নদীর ওপর নির্ভরশীল সব জেলের বুকেই এমন দীর্ঘশ্বাস। মাছঘাটগুলো এখন মাছের অভাবে খাঁ খাঁ করছে।
আমাদের গবেষণায় দেখা গেছে, সব নদ-নদীতে ইলিশ এক সময় ডিম পাড়ে না। একেক নদীতে ইলিশ একেক সময় ডিম পাড়ে। ফলে যখন ইলিশ যে নদীতে ডিম পাড়বে, সেই নদীতে তখন তা ধরায় নিষেধাজ্ঞা দিতে হবে। তাহলে ইলিশের উৎপাদন আরও কিছুটা বাড়ানো সম্ভব
দুলাল মিয়া বলেন, ৭০০ থেকে ৮০০ গ্রাম ওজনের ইলিশের মণ এখন ৬৫ থেকে ৭০ হাজার টাকা। অথচ আগে তা ৩৫ থেকে ৪০ হাজারে বেচাকেনা হতো। দুলালের ভাষায়, নদীতে ইলিশের আকালের কারণে এখন জাতীয় মাছটি ‘সোনার দামে’ বিক্রি হচ্ছে। উপকূলের জেলেদের পঞ্জিকার হিসাবে জুলাই থেকেই ইলিশের মৌসুম শুরু হয়। এ সময় নদীতে ইলিশের পরিমাণ বাড়তে থাকে।
জাটকাগুলো আকারে পরিণত হয়ে যায়। জেলেরাও এ সময় দাদন নিয়ে জাল-নৌকা মেরামত করে নদীতে নামেন ইলিশের আশায়। কিন্তু এবার জেলেদের সেই স্বপ্ন ফিকে হতে চলেছে। জালে মাছ না ওঠায় জেলেরা যেমন খালি হাতে ফিরছেন, তেমনি বরিশাল নগরের পোর্ট রোডের ইলিশের আড়তে নেই চিরচেনা হাঁকডাক। অলস সময় পার করছেন শ্রমিকেরা।
আদৌ কি ইলিশ মৌসুম আছে
উপকূলের জেলেরা জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর—এই তিন মাস ইলিশের মৌসুম ধরেন। কিন্তু এ সময়ে নদীতে ইলিশ কম পাওয়া যাওয়ায় এই মাছের নির্দিষ্ট কোনো মৌসুম আছে কি না, সেই প্রশ্ন ঘুরেফিরে আসছে।
ইলিশবিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এখন আর ইলিশের আলাদা কোনো মৌসুম নেই। সারা বছরই ইলিশ ধরা পড়ে দেশের নদ-নদী ও সাগরে। কেন মৌসুম হারিয়ে গেল—এমন প্রশ্নে বিশেষজ্ঞরা বলেন, আগে বর্ষা মৌসুম ছিল আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে। নব্বইয়ের দশকেও এই মৌসুমে প্রচুর বৃষ্টি হতো। কিন্তু ২০০৭ সালের পর দেশের ঋতুগুলোতে বেশ পরিবর্তন আসায় এখন বর্ষা মৌসুম সরে গিয়ে আগস্ট-সেপ্টেম্বর কিংবা অক্টোবরে চলে গেছে। যেহেতু ইলিশের উৎপাদন-প্রজনন সবকিছুই আবর্তিত হয় বর্ষা ঘিরে, তাই ইলিশের মৌসুমও সরে গেছে। আর ভালো ব্যবস্থাপনার কারণে এখন শীতেও ব্যাপক হারে ইলিশ মিলছে নদ-নদী ও সাগরে।
জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে আমাদের বর্ষা মৌসুমে এখন হেরফের হচ্ছে। ইলিশের প্রজনন, উৎপাদনেও তাই হেরফের হচ্ছে। বৃষ্টি, নদীতে স্রোত, পানির চাপ—এর সঙ্গে ইলিশের প্রজনন-উৎপাদন সম্পর্কিত। একই সঙ্গে পদ্মা-মেঘনাসহ উপকূলের নদ-নদীতে প্রচুর অবৈধ জাল, ডুবোচর ও দূষণের কারণেও নদ-নদীতে ইলিশ আসতে বাধা পাচ্ছে
বরিশাল আবহাওয়া বিভাগের উপাত্ত বলছে, গত ছয় মাসে বরিশাল অঞ্চলে স্বাভাবিক বৃষ্টি হয়নি। জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি দুই মাস ছিল বৃষ্টিবিহীন। মার্চে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বৃষ্টি হলেও এপ্রিলে আবার তা অস্বাভাবিকভাবে কমেছে। মে-জুন মাসেও স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টি হয়েছে।
চাঁদপুরে অবস্থিত মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আনিসুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, এখন মূলত সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসকে ইলিশের মূল মৌসুম ধরা হয়। এখন জুন-জুলাইকে ইলিশের ‘ডাল সিজন’ মনে করা হয়। তাই ইলিশ না পাওয়ায় হতাশার কিছু নেই। সামনে পাওয়া যাবে। তিনি বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে আমাদের বর্ষা মৌসুমে এখন হেরফের হচ্ছে। ইলিশের প্রজনন, উৎপাদনেও তাই হেরফের হচ্ছে। বৃষ্টি, নদীতে স্রোত, পানির চাপ—এর সঙ্গে ইলিশের প্রজনন-উৎপাদন সম্পর্কিত। একই সঙ্গে পদ্মা-মেঘনাসহ উপকূলের নদ-নদীতে প্রচুর অবৈধ জাল, ডুবোচর ও দূষণের কারণেও নদ-নদীতে ইলিশ আসতে বাধা পাচ্ছে।’
বরিশালে ইলিশ উৎপাদন বেড়েছে ৪৬ ভাগ
সরকারের নানা ব্যবস্থাপনা, নতুন অভয়াশ্রমসহ নানামুখী উদ্যোগের ফলে গত এক দশকে দেশে ইলিশের উৎপাদন দ্বিগুণের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। মৎস্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই উৎপাদন সাত লাখ টনে উন্নীত করা সম্ভব। গত অর্থবছরে দেশে ছয় লাখ টন ইলিশ আহরিত হয়। এই ইলিশের ৬৬ ভাগের বেশি আহরিত হয়েছে বরিশাল অঞ্চলের নদ-নদী ও সাগর থেকে। ২০২১-২২ অর্থবছরে বরিশাল অঞ্চলে মোট উৎপাদিত ইলিশের পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ৬৯ হাজার ৮৫১ টন।
বরিশাল মৎস্য অধিদপ্তরে সূত্র বলছে, গত এক যুগে বরিশাল বিভাগের জেলাগুলোতে ইলিশ আহরণ বেড়েছে ৪৬ ভাগ। এতে দেখা যায়, অর্থবছরে মোট ইলিশ উৎপাদিত হয়েছে ১ লাখ ৭০ হাজার ৭৬২ টন ইলিশ। এক যুগ পর তা বেড়ে হয়েছে ৩ লাখ ৬৯ হাজার ৮৫১ টন।
‘এলাকা বুঝে নিষেধাজ্ঞা দিতে হবে’
সরকারের নানমুখী উদ্যোগ, দেশি-বিদেশি বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবস্থাপনাসহ নানামুখী কাজের ফলে দেশে ইলিশের উৎপাদন ইতিবাচকভাবে বাড়লেও এখন এই উৎপাদনের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
মৎস্য অধিদপ্তর জানায়, দেশে ইলিশের উৎপাদন সাত লাখ টনে উত্তীর্ণ করতে মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে ১০টি সুপারিশমালা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো দেশের নদ-নদী ও সাগর থেকে আগামী দুই-তিন বছর পর্যন্ত প্রতিবারে সাত লাখ টনের বেশি ইলিশ আহরণ না করা।
সুপারিশমালার মধ্যে আরও আছে ইলিশের সর্বোচ্চ সহনশীল উৎপাদন বজায় রাখার জন্য মার্চ-এপ্রিলে জাটকার সর্বোচ্চ সুরক্ষা নিশ্চিতের কথা; প্রতিটি ইলিশকে জীবনচক্রে কমপক্ষে একবার হলেও ডিম ছাড়ার সুযোগ দেওয়া; প্রতিটি জাল ও জেলে নৌকা ডিজিটাল ট্যাগিংয়ের আওতায় আনা এবং সব জেলেকে ৬ দশমিক ৫ সেন্টিমিটার ফাঁসের জাল সরবরাহ নিশ্চিত করা।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও ইলিশ-বিশেষজ্ঞ মো. আবদুল ওহাব প্রথম আলোকে বলেন, দেশে ইলিশের উৎপাদন বাড়াতে হলে সঠিক সময়ে মা মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞার সময় নির্ধারণ করতে হবে। ইকো ফিশ-বাংলাদেশ প্রকল্পের সাবেক দলনেতা এই বিজ্ঞানী বলেন, ‘আমাদের গবেষণায় দেখা গেছে, সব নদ-নদীতে ইলিশ এক সময় ডিম পাড়ে না। একেক নদীতে ইলিশ একেক সময় ডিম পাড়ে। ফলে যখন ইলিশ যে নদীতে ডিম পাড়বে, সেই নদীতে তখন তা ধরায় নিষেধাজ্ঞা দিতে হবে। তাহলে ইলিশের উৎপাদন আরও কিছুটা বাড়ানো সম্ভব।’