নিঝুম দ্বীপ নিয়ে এত অবহেলা কেন

নিঝুম দ্বীপের নামার বাজারের পশ্চিমে সমুদ্রসৈকতছবি: প্রথম আলো

নিঝুম দ্বীপ। নামের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে অদ্ভুত এক মায়া। সম্ভবত সেই কারণেই ভ্রমণপিপাসু পর্যটকদের কাছে ব্যাপকভাবে পরিচিতি পেয়েছে নোয়াখালীর সর্বদক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে জেগে ওঠা এই দ্বীপ।

কয়েক বছর আগে নোয়াখালী জেলার ব্র্যান্ডিংও (পরিচিতি) করা হয়েছে নিঝুম দ্বীপের নামে। সেই থেকে নোয়াখালীকে ‘নিঝুম দ্বীপের দেশ’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। তখন বলা হয়েছিল, নিঝুম দ্বীপ ঘিরে গ্রহণ করা হবে নানা প্রকল্প, যাতে আরও বেশি আকৃষ্ট হবেন পর্যটকেরা। আয় বাড়বে সরকারের। কিন্তু বাস্তবে কিছুই হয়নি। নিঝুম দ্বীপের কপালে জুটেছে শুধুই অবহেলা।

সাম্প্রতিক সময়ে যাঁরা নিঝুম দ্বীপ গেছেন, তাঁদের কাছে মনে হবে দেশের সব চেয়ে অনুন্নত একটি অঞ্চল এটি। যেখানে যোগাযোগব্যবস্থার প্রায় পুরোটাই ভঙ্গুর। নেই শিক্ষা-চিকিৎসার কোনো সুব্যবস্থা। ঘুরতে যাওয়া কেউ যদি হঠাৎ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন, তাঁকে চিকিৎসার জন্য ছুটে যেতে হবে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার দূরের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কিংবা আরও ৭০ কিলোমিটার দূরের জেলা শহরের কোনো হাসপাতালে। দ্বীপে নেই তেমন কোনো ভালো যানবাহনও।

পর্যটকদের নিঝুম দ্বীপ গিয়ে ফিরতে হয় রাজ্যের ক্লান্তি আর ভোগান্তি সঙ্গে নিয়ে। তবে নিঝুম দ্বীপের গহিন বন, বনের ভেতর পাখিদের ডাক শুনে এবং দ্বীপের চারপাশের নদী ও সৈকতে ঘুরে বেড়িয়ে যাতায়াতের কষ্ট আর ক্লান্তি ভুলে থাকতে পারবেন।

বঙ্গোপসাগরের বুকে মেঘনা নদীর মোহনায় জেগে ওঠা এই চর হাতিয়ার মূল ভূখণ্ড থেকে দুই কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত। চর ওসমান, কামলার চর, পালকির চর, চর কবিরা, মৌলভীর চরসহ ছোট–বড় ১১টি চর নিয়ে নিঝুম দ্বীপ। পুরো চরের আয়তন প্রায় ১৪ হাজার ৫০ একর। ১৯৪০ সালের দিকে ধীরে ধীরে জেগে ওঠে দ্বীপটি। এরও প্রায় এক দশক পর দ্বীপে মানুষের আসা-যাওয়া শুরু হয়। তবে ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে দ্বীপের প্রায় সব মানুষ মারা যান। দ্বীপটি হয়ে যায় জনমানবশূন্য।

নিঝুম দ্বীপে পর্যটন করপোরেশনের নেওয়া অসমাপ্ত প্রকল্প
ছবি: প্রথম আলো

পরবর্তী সময়ে আবার মানুষের যাতায়াত শুরু হয় এবং ধীরে ধীরে মানুষের বসতি গড়ে ওঠে। ক্রমে তা বাড়তে থাকে। তখন দ্বীপটি ছিল হাতিয়ার জাহাজমারা ইউনিয়নের একটি ওয়ার্ড। ২০০১ সালের ৮ এপ্রিল দ্বীপটিকে জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করে সরকার। আর ২০১৩ সালে হাতিয়ার জাহাজমারা ইউনিয়ন থেকে আলাদা করে নিঝুম দ্বীপকে করা হয় স্বতন্ত্র একটি ইউনিয়ন। দ্বীপের নাম অনুসারেই ইউনিয়নের নামকরণ হয়। এই ইউনিয়নের জনসংখ্যা এখন প্রায় ৩০ হাজার। বেশির ভাগ মানুষের জীবিকা মাছ ধরা।

যা দেখবেন নিঝুম দ্বীপে

নিঝুম দ্বীপ বেড়াতে গিয়ে মূল দ্বীপের দক্ষিণে পালকির চরের বিশাল সৈকত দেখার পাশাপাশি উঠতি ঝাউবাগানে ঘুরে বেড়াতে পারেন। বনের গহিনে ঘুরে বেড়ানোর অনুভূতিও বেশ চমৎকার। বিকেল থেকে সন্ধ্যার মধ্যে চর কবিরার কাছে চৌধুরীর খাল দিয়ে হাঁটলে হরিণের দেখা পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে নিঝুম দ্বীপ দেখতে যাওয়া পর্যটকেরা দ্বীপে বন বিভাগের বাংলোর আশপাশে ঘুরে বেড়ানো একমাত্র হরিণ ছাড়া তেমন হরিণ দেখেন বলে জানা যায়। এ ছাড়া ট্রলার ভাড়া করে দ্বীপের ভেতরের খালগুলোতে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ রয়েছে। ১৪-১৫ জনের জন্য ট্রলারের ভাড়া পাওয়া যাবে ১ হাজার ২০০ টাকা থেকে দেড় হাজার টাকার মধ্যে। নিঝুম দ্বীপের চর কবিরায় পড়ন্ত বিকেলে হাজারো মহিষের পাল দেখে অন্য রকম এক ভালো লাগা কাজ করে।

কখন যাবেন

নিঝুম দ্বীপ বেড়াতে যাওয়ার জন্য সবচেয়ে উপযোগী সময় শীতকাল; অর্থাৎ নভেম্বরের শুরু থেকে ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ পর্যন্ত। এই সময়ের আবহাওয়া অনুকূল থাকায় নদী থাকে অনেক শান্ত। নৌ যাতায়াতও অপেক্ষাকৃত ঝুঁকিমুক্ত। এই সময়ে দ্বীপের সৌন্দর্য উপভোগ করা সহজ হয়। তবে বছরের অন্যান্য সময়, বিশেষ করে বর্ষাকালে, মেঘনা নদী ও বঙ্গোপসাগর উত্তাল হয়ে ওঠে, যা দ্বীপে যাত্রাকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলতে পারে।

যেভাবে যাবেন

ঢাকা থেকে বাসে চড়ে নিঝুম দ্বীপ যেতে চাইলে প্রথমে সায়দাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে নোয়াখালীগামী বিভিন্ন পরিবহন কোম্পানির চেয়ারকোচে চড়ে নোয়াখালীর সোনাপুর যেতে হবে। বাসের ভাড়া পড়বে ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকা। এসি ও নন-এসি উভয় ধরনের চেয়ার কোচ পাওয়া যায়। বাসযোগে সোনাপুর যাওয়ার পর সেখান থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশাযোগে চেয়ারম্যানঘাট যেতে হবে। সেখান থেকে সি-ট্রাক, ট্রলার কিংবা স্পিডবোটে চড়ে যেতে হবে হাতিয়ার নলচিরা ঘাটে। চেয়ারম্যানঘাট থেকে প্রতিদিন সি-ট্রাক ছাড়ে সকাল সাড়ে আটটায়। নলচিরা ঘাট থেকে অটোরিকশাযোগে হাতিয়ার ওছখালী হয়ে জাহাজমারা ইউনিয়নের মোস্তারিয়ারঘাট হয়ে নদীপথে নিঝুম দ্বীপ।

নিঝুম দ্বীপের ববিভাগের বাংলো এলাকায় দেখা মেলে এই হরিণটির। সম্প্রতি তোলা
ছবি: প্রথম আলো

চেয়ারম্যানঘাট থেকে নিঝুম দ্বীপ যাওয়ার পথে চেয়ারম্যানঘাট-নলচিরা ঘাটে চলাচলকারী সি-ট্রাকে যাতায়াত সবচেয়ে নিরাপদ। ভ্রমণের সঙ্গে সঙ্গে নদীর সৌন্দর্যও উপভোগ করা যায়। সি-ট্রাকে নলচিরা ঘাট পর্যন্ত ভাড়া জনপ্রতি ১৪৫ টাকা। ট্রলারে ২০০ টাকা আর স্পিডবোটে ৩৫০ টাকা। নলচিরা ঘাটে নেমে মোটরসাইকেল ভাড়া করে মোক্তারিয়া ঘাটে যেতে হবে। দুজনের জন্য ভাড়া ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা লাগবে। তবে নলচিরা ঘাট থেকে অটোরিকশা ভাড়া করেও মোক্তারিয়ারঘাট যাওয়া যায়। মোক্তারিয়াঘাট থেকে ট্রলারে করে নিঝুম দ্বীপের বন্দরটিলা ঘাটে পৌঁছাতে ৩০ টাকা ভাড়া লাগে। সেখান থেকে পুনরায় মোটরসাইকেলে চড়ে নিঝুম দ্বীপের নামার বাজার। ভাড়া জনপ্রতি ৫০ টাকা।

ঢাকা থেকে যেতে পারেন লঞ্চেও

ঢাকা থেকে নিঝুম দ্বীপ যাওয়ার সবচেয়ে সেরা উপায়টি হচ্ছে লঞ্চভ্রমণ। সদরঘাট থেকে প্রতিদিন বিকেল পাঁচটা থেকে সন্ধ্যা ছয়টার মধ্যে একটিমাত্র লঞ্চ হাতিয়ায় তমুরদ্দী ঘাটের উদ্দেশে ছেড়ে যায়। লঞ্চটি তমরুদ্দি ঘাটে পৌঁছায় পরদিন সকাল সাতটার মধ্যে। জোয়ার-ভাটার তারতম্যের কারণে কোনো কোনো সময় পৌঁছাতে খানিক দেরি হয়। তমরুদ্দি ঘাট থেকে ঢাকায় ফিরতি লঞ্চ ছাড়ে দুপুর সাড়ে ১২টায়। লঞ্চের ডেকে, সিঙ্গেল কেবিন ও ডাবল কেবিন এবং ভিআইপি কেবিন ভাড়া পাওয়া যায়। ডেকের ভাড়া জনপ্রতি ৫০০ টাকা। আর সিঙ্গেল কেবিন ১ হাজার ২০০ টাকা। ডাবল কেবিন ২ হাজার ২০০ টাকা এবং ভিআইপি কেবিনের ভাড়া ৪ হাজার থেকে ৬ হাজার টাকা পর্যন্ত। এরপর তমরুদ্দি ঘাট থেকে ট্রলার ভাড়া করে নিঝুম দ্বীপ যেতে পারবেন। আবার মোটরসাইকেল কিংবা অটোরিকশাযোগে মোক্তারিয়ারঘাট হয়ে যেতে পারবেন।

দ্বীপে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা

নিঝুম দ্বীপের বন্দরটিলা ও নামার বাজার সৈকতের কাছেই কয়েকটি হোটেল-রিসোর্ট আছে। এগুলোতে জনপ্রতি ১ হাজার ৫০০ থেকে ৩ হাজার টাকা খরচে বিভিন্ন ধরনের কক্ষ পাওয়া যায়। উল্লেখযোগ্য রিসোর্টগুলো হলো নামার বাজার সোহেল রিসোর্ট, নিঝুম রিসোর্ট, হোটেল শাহিন, হোটেল সোহেল, নামার বাজার মসজিদ বোর্ডিং, নিঝুম ড্রিম ল্যান্ড রিসোর্ট, বন্দরটিলা হোটেল দ্বীপ সম্পদ, জেলা পরিষদ ডাক বাংলো, বন বিভাগের ডাক বাংলো, মাহমুদ বোর্ডিং, হোটেল আমেনা ইন্টারন্যাশনাল। খাবারের জন্য স্থানীয় বেশ কয়েকটি হোটেল রয়েছে, যেখানে ইলিশসহ নদীর বিভিন্ন মাছের পাশাপাশি স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত চালের ভাত, মাছ, মুরগি, ডিম ইত্যাদি খাবার পাওয়া যায়।

যাতায়াতে ভোগান্তি, নেই চিকিৎসার ব্যবস্থা

নিঝুম দ্বীপ ভ্রমণে দ্বীপের ভেতরে যাতায়াতব্যবস্থা বেশ নাজুক। দ্বীপের একমাত্র পাকা সড়কটি জোয়ারের পানির তোড়ে ভেঙে গেছে অনেক স্থানে। বছরের পর বছর ধরে ভাঙা সড়কটি সংস্কার হয়নি। দ্বীপের বন্দরটিলা এলাকার নদীর ঘাট থেকে নামার বাজার পর্যন্ত প্রায় ১০ কিলোমিটার সড়কের বেশির ভাগই ভাঙা। সড়কের একাধিক স্থানে কালভার্ট ভেঙে গেছে জোয়ারের তোড়ে। সেখানে কাঠের সেতু নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে, যা দিয়ে কোনোরকমে মোটরসাইকেল চলাচল করতে পারে।

একইভাবে জনবসতির প্রায় ৫০ বছরেও দ্বীপটিতে মানসম্মত কোনো স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র গড়ে ওঠেনি। তাই এখানকার বাসিন্দাদের কাছে ‘বড় ডাক্তার’ হলেন গ্রামের পল্লিচিকিৎসক কিংবা ওষুধের দোকানিরা।

স্থানীয় বাসিন্দা জয়নাল আবদিন বলেন, শুধু সড়কই নয়, এখানে নেই ভালো কোনো চিকিৎসাকেন্দ্র। দ্বীপে ৩টি কমিউনিটি ক্লিনিক ও ১টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্রে থাকলেও নেই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। স্বাস্থ্যকর্মীদের দেখা মেলে মাঝেমধ্যে।

দ্বীপের একমাত্র পাকা সড়কটিই বেহাল
ছবি: প্রথম আলো।

আসলেই কি হরিণ দেখা যায়?

নিঝুম দ্বীপ বেড়াতে যান, এমন মানুষদের বেশি আগ্রহ থাকে বনের ভেতর কাছ থেকে হরিণের পাল দেখার। কিন্তু গত কয়েক বছরে নিঝুম দ্বীপের বনে ঘুরতে গিয়ে হরিণের দেখা খুব একটা মেলেনি। তবে একটি হরিণ সবাই কমবেশি দেখেছেন এটা বলা যায়। সেই হরিণ বেশির ভাগ সময়ই থাকে বন বিভাগের বাংলোর আশপাশে। স্থানীয় কর্মকর্তারা জানান, হরিণটি বাচ্চা অবস্থা থেকে কার্যালয়ের আশপাশে থাকে। তাঁরাই হরিণটি দেখাশোনা করে বড় করেছেন। যাঁরা বেড়াতে আসেন, তাঁরাও হরিণটিকে নানা খাবার দেন। সেটি বনে যায় না। সারাক্ষণ নিঝুম দ্বীপের নামার বাজার ও আশপাশের এলাকায় ঘুরে বেড়ায়।

সম্প্রতি নিঝুম দ্বীপ ভ্রমণ করতে যাওয়া স্কুলশিক্ষক নূর হোসেন বলেন, নিঝুম দ্বীপকে নোয়াখালী জেলার ব্র্যান্ডিং করার পর ভেবেছিলেন, সেখানে সরকারি উদ্যোগে অনেক কিছু করা হয়েছে। কিন্তু গত নভেম্বর মাসে বেড়াতে গিয়ে তিনি হতাশ হয়েছেন। বনে হরিণের দেখা পাননি। যাতায়াতে সীমাহীন ভোগান্তিই ছিল নিত্যসঙ্গী।

প্রশাসন যা বলল

জেলা প্রশাসক খন্দকার ইসতিয়াক আহমেদের প্রথম আলোকে বলেন, নিঝুম দ্বীপকে পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলতে পর্যটন করপোরেশনের উদ্যোগে দুটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছিল। কিন্তু প্রকল্প দুটির কাজ করা যায়নি। এর মধ্যে প্রকল্পের মেয়াদও শেষ হয়ে গেছে। এ ছাড়া জোয়ারের আঘাতে দ্বীপের পাকা সড়কের যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, সেগুলো তিনি সম্প্রতি দেখে এসেছেন। বিভাগীয় কমিশনারও নিঝুম দ্বীপ ঘুরে গেছেন এর মধ্যে। দ্বীপের সড়ক, চিকিৎসাব্যবস্থাসহ সার্বিক উন্নয়নে প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে। আশা করা হচ্ছে শিগগিরই দ্বীপের সমস্যা সমাধানের কাজ শুরু হবে।