ঋণের দায় এড়াতে খুনের নাটক সাজান বিয়ানীবাজারের নাহিদ
সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার মাথিউরা ইউনিয়নের পূর্বপার গ্রামের একটি বাড়িতে তত্ত্বাবধায়কের চাকরি করতেন মো. নাহিদ ইসলাম (২৮) নামের এক তরুণ। গত শুক্রবার ভোরে নাহিদ ইসলামের ঘরের বিছানা, মেঝে এবং বারান্দায় রক্তজাতীয় তরল পাওয়া গিয়েছিল। এর পর থেকে তাঁর কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছিল, নাহিদ খুন হয়েছেন।
পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে এসেছে, ঘরের ভেতরে পড়ে থাকা রক্তজাতীয় তরল আর নাহিদের নিখোঁজ হওয়ার বিষয়টি পুরোপুরি সাজানো। গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় নরসিংদী থেকে নাহিদকে আটক করেছে পুলিশ। আটকের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে নাহিদ জানিয়েছেন, জুয়া খেলে তিনি ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। ঋণের টাকার পরিশোধ এড়াতে তিনি খুন হওয়ার নাটক সাজিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন। আজ রোববার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে সিলেটের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মামুন নিজ কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে সাংবাদিকদের এসব তথ্য জানান।
নাহিদের প্রকৃত নাম মো. তাজুল ইসলাম। তাঁর বাড়ি নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলার বড়ভিটা পূর্বপাড়া গ্রামে। প্রায় ১৪ বছর আগে বাড়ি থেকে পালিয়ে বিয়ানীবাজারে এসেছিলেন নাহিদ ওরফে তাজুল। বিয়ানীবাজারে আসার পর থেকে আর কখনো বাড়িতে যাননি। এর মধ্যে বিয়ানীবাজার আসার পর জাতীয় পরিচয়পত্রে নিজের নাম পাল্টে রাখেন ‘নাহিদ ইসলাম’। স্থায়ী ঠিকানাও বদলে ফেলেন সেখানে। তবে মা–বাবার নাম অপরিবর্তিত রেখেছিলেন।
সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, শুক্রবার বিয়ানীবাজারের মাথিউরা ইউনিয়নের পূর্বপার গ্রামের আবদুল হেকিমের বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক নাহিদের ঘরের বিছানা ও মেঝেতে রক্তজাতীয় পদার্থ পাওয়া যায়। বিষয়টি প্রথমে হত্যাকাণ্ড হিসেবে ধারণা করে পুলিশ তদন্ত করছিল। একই সঙ্গে নিহত ব্যক্তির লাশ উদ্ধারের জন্য তিনি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের চাপ দিচ্ছিলেন। তবে তদন্তে জানা যায়, ঘটনাটি সাজানো। রক্তজাতীয় যে পদার্থ পাওয়া গেছে, সেটি আসলে ছিল রং। ওই তরল পদার্থ ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পরীক্ষা করেও সেখানে রক্তের সুনির্দিষ্ট অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। ওই দিন পুলিশ ওই ঘর থেকে একটি বালতি, মগ ও কাঠি উদ্ধার করেছে। ওই বালতি ধুয়ে ফেলা হলেও কাঠিসহ মগে কিছুটা লাল রং পাওয়া গিয়েছিল। এর পর থেকে তথ্যপ্রযুক্তির সহযোগিতায় পুলিশ নাহিদকে খুঁজতে থাকে। অবশেষে ৪০ ঘণ্টার অভিযানে নাহিদকে উদ্ধার করা হয়েছে।
পুলিশ জানায়, তাজুল কলেজে পড়া অবস্থায় বন্ধুদের সঙ্গে মারামারির সময় একজন মারা গেলে তিনি বাড়ি থেকে পালিয়ে আসেন। এরপর আর বাড়ি ফেরেননি। প্রায় তিন বছর আগে বাবার মৃত্যু হলেও বাড়িতে পুলিশ আছে, এমন তথ্য পেয়ে আর যাননি। নাহিদ যে ঘরে থাকতেন, সেখান থেকে একটি ডায়েরি উদ্ধার করা হয়েছে। সেখানে বিভিন্নজনের কাছে তাঁর ঋণ নেওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। নাহিদ নিখোঁজের এক দিন আগে বিয়ানীবাজারে তাঁর মুঠোফোন বিক্রি করে দেন। পরে ওই মুঠোফোন উদ্ধার করা হয়। সেখান থেকে অনলাইনে জুয়া খেলার বিষয়ে বেশ কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। মূলত জুয়া খেলে নাহিদ বিভিন্নজনের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছিলেন।
পুলিশ সুপার বলেন, নাহিদ তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে যা বেতন পেতেন, সেটি দিয়ে জুয়ার টাকা জোগান দিতে পারছিলেন না বলে তিনি ঋণ নিয়েছিলেন। ওই টাকা পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ায় নাহিদ নাটক সাজিয়েছিলেন বলে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন। তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় তদন্ত করে জানা যায়, নিখোঁজের আগে নাহিদ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ খুঁজছিলেন। ওই তথ্যের সূত্র ধরে নরসিংদী থেকে তাঁকে গতকাল আটক করা হয়। তবে নাহিদের বিরুদ্ধে পুলিশ আপাতত কোনো আইনি ব্যবস্থা নেয়নি। অনেক পাওনাদার পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। কেউ লিখিত অভিযোগ করলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ সুপার ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন সিলেটের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (বিয়ানীবাজার জকিগঞ্জ সার্কেল) জাকির হোসেন, বিয়ানীবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. তাজুল ইসলাম।