ছয়জনের গাফিলতিতে কেন্দ্র হয়ে শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছেছে ভুল প্রশ্নপত্র

বিজয় স্মরণী কলেজফাইল ছবি

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বিজয় সরণি কলেজ কেন্দ্রে উচ্চমাধ্যমিক (এইচএসসি) পরীক্ষার্থীদের ভুল প্রশ্নপত্র দেওয়ার ঘটনায় পাঁচ কর্মকর্তা ও পুলিশের এক সদস্যকে দায়ী করছে উপজেলা প্রশাসনের গঠিত তদন্ত কমিটি। গতকাল শুক্রবার তদন্ত কমিটি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কে এম রফিকুল ইসলামের কাছে প্রতিবেদন জমা দেয়। তিনি বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আগামীকাল রোববার জেলা প্রশাসক ও চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান বরাবর চিঠি দেবেন বলে জানান।

ওই ছয় কর্মকর্তা হলেন পরীক্ষাকেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শিব শংকর শীল, পরীক্ষা কমিটির আহ্বায়ক মো. নোমান, কেন্দ্রের পরীক্ষা কমিটির সদস্য সহকারী অধ্যাপক শহীদুল্লাহ আজাদ ও প্রভাষক ফারজানা আক্তার, উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা (ট্যাগ অফিসার) এবং এক পুলিশ কনস্টেবল। ঘটনার পরপরই ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, কমিটির আহ্বায়ক, দুই সদস্যসহ চারজনকে তাঁদের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। জেলা প্রশাসনের ট্রেজারিতে রুটিন অনুযায়ী, প্রশ্নপত্র সাজানো ও কেন্দ্রে প্রশ্নপত্র বিতরণ—এ দুই স্তরেই দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের গাফিলতি হয়েছে বলে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়।

তদন্ত–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, প্রথমত, ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা প্রশ্ন বাছাইয়ের কাজে ট্রেজারিতে যাঁদের পাঠিয়েছেন, তাঁরা পদার্থবিজ্ঞান প্রথম পত্রের খামে দ্বিতীয় পত্রের প্রশ্নপত্র ঢুকিয়েছেন। ফলে ভুল প্রশ্নপত্র কেন্দ্রে পৌঁছেছে। দ্বিতীয়ত, কেন্দ্রে কক্ষভিত্তিক প্রশ্নপত্র বণ্টনের আগে প্যাকেট খোলার সময় বিষয় ও কোড যাচাই করে তিনজন কর্মকর্তার স্বাক্ষর দিয়ে প্যাকেট খুলতে হয়। তাঁরা হলেন কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, উপজেলা প্রশাসনের পাঠানো ট্যাগ অফিসার ও পুলিশের সদস্য। তিনজনেই প্রশ্নপত্র বের করার আগে প্যাকেটের গায়ে স্বাক্ষর করেছেন; কিন্তু তাঁরা সূচি অনুযায়ী বিষয় ও পত্র কোড মেলাননি। তাঁরা যদি যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করতেন, তাহলে প্যাকেট খোলার আগেই ভুল ধরা পড়ত। ভুল প্রশ্নপত্র পরীক্ষার্থীদের হাতে যেত না। পুনরায় সঠিক প্রশ্ন এনে পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব হতো।

গত বৃহস্পতিবার পদার্থবিজ্ঞান প্রথম পত্রের সৃজনশীল প্রশ্নপত্রের পরিবর্তে বিজয় সরণি কলেজ কেন্দ্রের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের দ্বিতীয় পত্রের সৃজনশীল প্রশ্নপত্র দেওয়া হয়। ঘটনার পর কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার দায়িত্ব দেওয়া হয় ওই কলেজের সহকারী অধ্যাপক আবু হেনা মো. মোস্তফা জামালসহ অন্য তিন শিক্ষককে।

অব্যাহতিপ্রাপ্ত পরীক্ষা কমিটির আহ্বায়ক মো. নোমান প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিটি পরীক্ষায় প্রতিটি বিষয়ের দুটি সেট ট্রেজারি থেকে দেওয়া হয়। পরীক্ষা শুরুর আগেই জেলা প্রশাসন থেকে কোন সেটের প্রশ্নের পরীক্ষা হবে, তার মেসেজ দেওয়া হয়। গত বৃহস্পতিবারের পরীক্ষার জন্য তাদের দেওয়া হয় ২ ও ৪ নম্বর সেটের প্রশ্ন। ২ নম্বর সেটের প্রশ্নে পরীক্ষা হবে বলে মেসেজ করা হয়। সৃজনশীল প্রশ্ন শিক্ষার্থীদের হাতে দেওয়ার আগেই হল পর্যবেক্ষকদের চোখে পড়ে, প্রশ্ন ভুল এসেছে। প্রশ্ন ভুলের খবরে তাঁরা ভীত হয়ে পড়েন। কী করবেন, বুঝে উঠতে পারছিলেন না। পরে ট্রেজারি থেকে সঠিক প্রশ্নের সেট আসার পর পরীক্ষা নেন। শিক্ষার্থীদের হাতে দ্বিতীয় পত্রের প্রশ্ন দেননি তাঁরা। বিষয়টি অতিরঞ্জিত করা হয়েছে।

গত বৃহস্পতিবারের এ ঘটনার পর উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. আলাউদ্দীনকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির অপর সদস্যরা হলেন উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. হাবিবুল্লাহ ও উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা এস এম মোস্তফা আলম সরকার। কমিটিকে এক কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়।

কমিটির প্রধান মো. আলাউদ্দীন প্রথম আলোকে বলেন, গতকাল শুক্রবার তাঁরা ঘটনাটি তদন্ত করে প্রতিবেদন তৈরি করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে জমা দিয়েছেন। ইউএনও পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।

ইউএনও কে এম রফিকুল ইসলাম বিজয় সরণি কলেজের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, প্রশ্নপত্রের ভুলটি যদি প্যাকেট খোলার সময় ধরা পড়ত, তাহলে এ সমস্যা হতো না। কেন্দ্রে সমস্যা হতেই পারে। শুরুতে কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কিংবা পরীক্ষা কমিটির আহ্বায়ক বিষয়টি তাঁকে জানাতে পারতেন; কিন্তু তাঁরা নিজেরাই ট্রেজারিতে যোগাযোগ করে সঠিক প্রশ্ন আনার চেষ্টা করেছেন। ট্রেজারি থেকেই এত বড় সমস্যার বিষয়টি তিনি প্রথম জানতে পারেন। এরপরই চারজনকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেন।

ইউএনও আরও বলেন, বোর্ডের নির্দেশনা অনুযায়ী কেন্দ্রে তিনজনের স্বাক্ষরে পরীক্ষার প্যাকেট খোলার নিয়ম। এ কাজে পুলিশের একজন উপপরিদর্শক পদমর্যাদার কর্মকর্তা থাকা উচিত। ন্যূনতম সহকারী উপপরিদর্শক থাকা উচিত। তাহলে তিনি বিষয়টি বুঝতেন। ভবিষ্যতের জন্য এ ব্যবস্থা করতে হবে।

এ বিষয়ে সীতাকুণ্ড থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কামাল উদ্দিন বলেন, পুলিশের দায়িত্ব হচ্ছে প্রশ্ন নিরাপদে কেন্দ্রে পৌঁছে দেওয়া এবং পরীক্ষা চলার সময়ে কেন্দ্র নিরাপদ রাখা। যদি প্রশ্নের প্যাকেটের ওপর তাঁদের পুলিশের সদস্য স্বাক্ষর করে থাকেন, তাহলে এই অর্থে করেছেন যে তিনি নিরাপদে প্রশ্ন পৌঁছে দিয়েছেন। তা ছাড়া পুলিশ কর্মকর্তা দিতে হবে, কেন্দ্র থেকে কিংবা উপজেলা শিক্ষা অফিস থেকে এ রকম নির্দেশনা বা চিঠি থানাকে দেওয়া হয়নি। এখন তাঁদের কর্মকর্তা-সংকট চলছে। এ কারণে তাঁরা সেখানে কনস্টেবল পাঠিয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন। কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেওয়ার নির্দেশনা থাকলে সে অনুসারে তাঁরা ব্যবস্থা নেবেন।

গত বৃহস্পতিবার বিজয় সরণি কলেজ কেন্দ্রে সকাল ১০টায় যথানিয়মে পদার্থবিজ্ঞান প্রথম পত্রের নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্নপত্র দিয়ে পরীক্ষা শুরু হয়। পরীক্ষার্থীরা নির্ধারিত ২৫ মিনিট নৈর্ব্যক্তিক পরীক্ষা দেন। সকাল সাড়ে ১০টায় সৃজনশীল প্রশ্নপত্র বিতরণ করার পর শিক্ষার্থীরা দেখতে পান, প্রথম পত্রের বদলে পদার্থবিজ্ঞান দ্বিতীয় পত্রের প্রশ্নপত্র দেওয়া হয়েছে। পরবর্তী সময়ে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বিতরণ করা প্রশ্নপত্র ফেরত নেওয়া হয়। দেড় ঘণ্টা পর ট্রেজারি থেকে প্রথম পত্রের প্রশ্ন এনে পরীক্ষা নেওয়া হয়।