সুনামগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জ
পর্যটকদের ফেলা বর্জ্যে হাওরে দূষণ
নৌকা থেকে পানির বোতল, চিপস-বিস্কুটের প্যাকেট, পলিথিনসহ প্লাস্টিক বর্জ্য ছুড়ে হাওরের প্রকৃতি, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি করছেন পর্যটকেরা।
হাওয়ার তোড়ে, ঢেউয়ের তালে দোল খাওয়া নৌকায় হাওরের বুকে ভেসে বেড়ানো ভ্রমণপিপাসুদের কাছে বেশ উপভোগ্য। হাওরে পানির বুক চিরে জেগে থাকা গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে পর্যটকেরা নৌকা নিয়ে ঘুরে বেড়ান। পর্যটক যেভাবে প্রতিবছর বাড়ছে, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে পর্যটকসৃষ্ট দূষণও। নৌকা থেকে পানির বোতল, চিপস-বিস্কুটের প্যাকেট, পলিথিনসহ প্লাস্টিক বর্জ্য ছুড়ে হাওরের প্রকৃতি, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি করছেন পর্যটকেরাই।
হাওরে বেড়ানোর জনপ্রিয় দুটি গন্তব্যের একটি হলো সুনামগঞ্জ, অন্যটি কিশোরগঞ্জ। সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর, শহীদ সিরাজ লেক (নিলাদ্রী), বারেকটিলা, জাদুকাটা নদী আর শিমুলবাগান ভ্রমণের স্থান হিসেবে পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয়। অন্যদিকে কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ, ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম, নিকলীর বিভিন্ন স্থানসহ হাওরের দৃষ্টিনন্দন অলওয়েদার সড়ক দেখতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসেন অসংখ্য পর্যটক।
হাওরের পরিবেশ রক্ষায় পর্যটক ও এলাকাবাসীর উদ্দেশে গত ২ আগস্ট ১২ দফা নির্দেশনা দিয়েছিল সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলা প্রশাসন। এতে পর্যটক ও নৌকার কর্মীদের মধ্যে সচেতনতা কিছুটা বেড়েছে। তবে হাওরের পানিতে বর্জ্য ফেলা বন্ধ হয়নি। অন্যদিকে কিশোরগঞ্জের হাওরগুলোতে দূষণ রোধে প্রশাসনের তরফ থেকে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি এখনো। এর ফলে ঘুরতে যাওয়া লোকজন সেখানে দেদার প্লাস্টিক বর্জ্য ফেলছেন।
পানি শুকিয়ে গেলে হাওরের এই জমিগুলোতেই ফসল চাষ করেন কৃষকেরা। তাঁদের অভিযোগ, এসব বর্জ্য পানিতে না পচে দীর্ঘদিন পর্যন্ত অক্ষত থাকে। এর ফলে শুকনা মৌসুমে ফসল আবাদ করতে গিয়ে বিপাকে পড়েন তাঁরা। পরিবেশ আন্দোলনের কর্মীরাও বলছেন, প্লাস্টিকের দূষণ ছাড়াও শব্দদূষণ ও ইঞ্জিনচালিত নৌকার অবাধ চলাচলে হাওরে নষ্ট হচ্ছে মাছের বিচরণক্ষেত্র, কমছে পাখি।
সুনামগঞ্জ পরিবেশ আন্দোলনের যুগ্ম আহ্বায়ক সাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, টাঙ্গুয়ার হাওরের প্রকৃতি-পরিবেশ নিয়ে তাঁরা উদ্বিগ্ন। হাওরে গাছ, মাছ, পাখি কমছে। প্রতিদিন শত শত পর্যটকবাহী নৌকা চলে। তাঁরা পানিতে বর্জ্য ফেলছেন, অনেকেই নৌকায় উচ্চ শব্দের বাদ্যযন্ত্র নিয়ে যান। ইঞ্জিনচালিত নৌকার কারণে মাছের বিচরণ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, কমছে পাখি। প্রশাসনের নির্দেশনা পর্যটকদের অনেকেই মানছেন না।
সম্প্রতি পর্যটন নৌকায় করে সুনামগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জের হাওরগুলোতে গিয়ে দেখা গেছে, হাওরের পানিতে প্লাস্টিক বর্জ্য ফেলার বিষয়ে পর্যটক ও নৌকার কর্মীরা খুব একটা সচেতন নন। অল্প কিছু নৌকা ছাড়া বাকিগুলোতে ময়লা-আবর্জনা ফেলার কোনো ডাস্টবিনেরও দেখা মেলেনি। ঘাটে থাকা নৌকাগুলোর আশপাশেই পানিতে ভাসছিল পলিথিন, চিপসের প্যাকেট, পানির খালি বোতল।
তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রায়হান কবিরের দাবি, প্রশাসনের নির্দেশনা জারির পর থেকে পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। এ পর্যন্ত ১১৫টি নৌকা নিবন্ধন নিয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি ঘুরে দেখেছি, হাওরের পর্যবেক্ষণ টাওয়ার এলাকায় মানুষ এখন পানিতে কম ময়লা ফেলেন। তবে টেকেরঘাট এলাকায় যেখানে নৌকাগুলো রাত্রিযাপন করে সেখানে আরও কাজ করতে হবে।’
টাঙ্গুয়ার হাওরের গোলাবাড়ি এলাকার পর্যবেক্ষণ টাওয়ারে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে হাওরের পানিতে নেমে সাঁতার কেটে আনন্দ-উল্লাস করছেন ১০-১২টি নৌকার পর্যটকেরা। টাওয়ারের পাশেই পানিতে ভাসছে পর্যটকদের ফেলা নানা রকমের বর্জ্য। কুমিল্লা থেকে সেখানে ঘুরতে আসা পর্যটক আরিফুল ইসলাম (৩৩) প্রথম আলোকে বলেন, ‘এমনিতে পরিবেশটা খুবই সুন্দর। কিন্তু পানিতে নামার পর মুখের কাছে যখন হঠাৎ একটি পলিথিনের প্যাকেট ভাসতে দেখলাম, তখন খারাপই লেগেছে। যাঁরা ঘুরতে আসেন, তাঁদেরই সচেতন হতে হবে আগে। পানিতে ময়লা-আবর্জনা ভেসে থাকলে তো নামতে মন চাইবে না।’
পর্যটকবাহী নৌকার মাঝি আলী আকবরকে (৪০) হাওরে ভেসে থাকা বর্জ্য দেখালে তিনি জানান, নৌকায় ওঠার সঙ্গে সঙ্গে প্রশাসনের নির্দেশনার বিষয়ে পর্যটকদের জানান তাঁরা। কিন্তু অনেকেই এ বিষয়ে গুরুত্ব দেন না। বিশেষ করে তরুণেরা এসব মানতে চান না। পর্যটকদের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বাড়ানোর সুযোগও তাঁদের থাকে না।
কিশোরগঞ্জের মিঠামইনের হাওরে ইঞ্জিনচালিত নৌকার চালক দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমরা পর্যটকদের পানিতে ময়লা ফেলতে না করি। অনেকেই শোনেন, কিন্তু বেশির ভাগই মানেন না। যে প্যাকেটে চিপস খাচ্ছেন, সেই প্যাকেটটাই পানিতে ফেলছেন; যে বোতলে পানি খাচ্ছেন, সেই বোতলটাই পানিতে ফেলছেন তাঁরা। আবার খাবার প্যাকেটটাও পানিতে ফেলে দিচ্ছেন।’
হাওর শুকিয়ে গেলে এসব প্লাস্টিক বর্জ্য জমিতে পড়ে থাকে। সেগুলো আলাদাভাবে পরিষ্কার করতে হয় কৃষকদের। মিঠামইন সদরের কৃষক ছাদির মিয়া বলেন, ‘পানি গেলেগা আগে আমরা সুন্দর করে ফসল চাষ করতে পারতাম। এখন দেহা যায়, জমিতে অনেক বোতল–আবর্জনা জমা হয়ে থাকে। এতে ফসলের ক্ষতি হইতাছে।’
হাওরে পর্যটকদের ফেলা বর্জ্যে কৃষকদের ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে কিশোরগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. আবদুস ছাত্তার প্রথম আলোকে বলেন, পর্যটকদের ফেলা অপচনশীল বর্জ্য জমিতে মিশছে। এতে পরিবেশ যেমন দূষিত হচ্ছে, তেমনি পানি শুকালে কৃষকদেরও সমস্যা হচ্ছে। পর্যটকেরা সচেতন হয়ে রাস্তার পাশে ডাস্টবিনে বা নির্দিষ্ট স্থানে ময়লা ফেললে পরিবেশ ও হাওরের এই ক্ষতিটা হতো না।