জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
পড়াশোনা শেষেও হল ছাড়ে না ছাত্রলীগ
স্নাতকোত্তর শেষ হওয়ার পরও এক হাজারের মতো শিক্ষার্থী হলে থাকছেন। তাঁদের অধিকাংশই ছাত্রলীগের রাজনীতিতে যুক্ত।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৩ ব্যাচের শিক্ষার্থী মো. হাবিবুর রহমান ভর্তি হয়েছিলেন পোষ্য কোটায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী, তাঁর আবাসিক সুবিধা পাওয়ার সুযোগ নেই। অথচ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার সুবাদে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের দুটি কক্ষ দখল করে থাকছেন। এমনকি ছাত্রত্ব শেষেও তিনি হলেই থাকছেন।
দেশের একমাত্র পূর্ণাঙ্গ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে পরিচিত জাহাঙ্গীরনগরে কয়েক বছর ধরে চলছে আবাসনসংকট। শিক্ষাজীবন শেষ হলেও এক হাজারের মতো শিক্ষার্থী আসন দখল করে থাকছেন। যাঁদের বেশির ভাগ ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। ফলে সাধারণ শিক্ষার্থীরা আসন পাচ্ছেন না।
শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা বলছেন, বিভিন্ন সময় হলে অবৈধভাবে অবস্থানকারীদের সরিয়ে বৈধ শিক্ষার্থীদের আসন নিশ্চিতের দাবিতে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করেছেন। আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রশাসন একাধিকবার অবৈধভাবে অবস্থানরতদের হল ছাড়ার নির্দেশও দেয়। তবে সেই নির্দেশনা আর বাস্তবায়ন করেনি প্রশাসন। আবাসনসংকট নিরসনে সম্প্রতি ৪৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে ১০ তলাবিশিষ্ট ছয়টি হল নির্মাণ করা হয়েছে। যার চারটি ইতিমধ্যে খুলে দেওয়া হয়েছে। হলগুলো প্রতিটি এক হাজার আসনের। বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে ছেলেদের ১০টি ও মেয়েদের ৯টি হলে শিক্ষার্থীরা থাকছেন। ছেলেদের ১০টি হলে আসন ৬ হাজার ৬৪০টি। অবশ্য মেয়েদের হলে আবাসনসংকট তেমন নেই।
পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে অছাত্রদের হল থেকে বের করার নির্দেশ দিয়েছি। এবার যেটা বলেছি সেটা বাস্তবায়ন করেই ছাড়ব। আমাকে জাস্ট পাঁচটা দিন সময় দাও তারপর দেখো কী ব্যবস্থা নিই। হলে কোনো অছাত্র থাকবে না।অধ্যাপক মো. নূরুল আলম, উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
দখলকারীদের অধিকাংশই ছাত্রলীগের
সাধারণ শিক্ষার্থী ও প্রশাসনের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ বিভাগের ৪৬তম ব্যাচের শিক্ষার্থীরা স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন। বেশ কয়েকটি বিভাগের ৪৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থীদের স্নাতকোত্তর পরীক্ষা চলছে। সে হিসেবে বর্তমানে ৪৭তম থেকে ৫২তম ব্যাচের শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রম চালু রয়েছে। তবে হলগুলোতে ৪১তম থেকে ৪৬তম ব্যাচের এক হাজারের মতো সাবেক শিক্ষার্থী অবৈধভাবে থাকছেন। তাঁদের বেশির ভাগই ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।
হলগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্নাতকোত্তর শেষ হলেও বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি আকতারুজ্জামান সোহেলের (৪২ ব্যাচ) নিয়ন্ত্রণে আছে মওলানা ভাসানী হলের ৩২০ ও ৩২২ নম্বর কক্ষ। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান (৪৩ ব্যাচ) থাকেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের ৩৪৯ ও ৪৪৭ নম্বর কক্ষে। প্রতিটি কক্ষ চার আসনের। ৪১তম ব্যাচের সাবেক শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগ নেতা মিজানুর রহমান বঙ্গবন্ধু হলের ৩২২ নম্বর ও জুবায়ের আহমেদ মওলানা ভাসানী হলের ৩২৩ নম্বর কক্ষে থাকেন। আরমান খান থাকেন মওলানা ভাসানী হলের ১২৬ নম্বর কক্ষে। এদের মধ্যে মিজানুর রহমান শাখা ছাত্রলীগের গত কমিটির সহসভাপতি। জুবায়ের মওলানা ভাসানী হল কমিটির সভাপতি পদপ্রার্থী ছিলেন। আরমান কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি আল নাহিয়ান খানের ছোট ভাই।
বর্তমানে ৪৭তম থেকে ৫২তম ব্যাচের শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রম চালু রয়েছে। তবে হলগুলোতে ৪১তম থেকে ৪৬তম ব্যাচের এক হাজারের মতো সাবেক শিক্ষার্থী অবৈধভাবে থাকছেন। তাঁদের বেশির ভাগই ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।
জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি আকতারুজ্জামান সোহেল প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের এই সিদ্ধান্তকে (অছাত্রদের হল ছাড়তে নির্দেশ) সাধুবাদ জানাই। সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে প্রয়োজনে ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে প্রশাসনকে সহযোগিতা করা হবে।’ হলে অবৈধভাবে তাঁর কক্ষ দখল করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি হলের বাইরে থাকি। মাঝেমধে৵ হলে এসে থাকি।’
হল প্রশাসন ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বঙ্গবন্ধু হলে ১২০ থেকে ১৫০, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলে ৮০ থেকে ১০০, আল বেরুনী হলে ৪০ থেকে ৫০, মওলানা ভাসানী হলে ১০০ থেকে ১২০, শহীদ রফিক জব্বার হলে ১২০ থেকে ১৩০, আ ফ ম কামাল উদ্দিন হলে অন্তত ১০০, শেখ রাসেল হলে ৪০ থেকে ৪২, মীর মশাররফ হোসেন হলে ১০০ থেকে ১২০, শহীদ সালাম বরকত হলে ১০০ থেকে ১২০ জন অবৈধ শিক্ষার্থী রয়েছেন। সব মিলিয়ে এ সংখ্যা ৮০০ থেকে ১ হাজার।
নির্দেশনা বাস্তবায়িত হয় না
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শৃঙ্খলাসংক্রান্ত অধ্যাদেশ ২০১৮-এর ৫ (ট) ধারা অনুযায়ী, স্নাতকোত্তর চূড়ান্ত পরীক্ষা শেষ হওয়ার সাত দিনের মধ্যে শিক্ষার্থীদের পরিচয়পত্র, চিকিৎসা ও গ্রন্থাগার কার্ড ফেরত দিয়ে আবাসিক হল ত্যাগ করতে হবে। এ বিধি অমান্য করলে শাস্তি হিসেবে পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ স্থগিত থাকবে। তবে এ নিয়ম কার্যকর নয় বলে জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। ফলে বিভিন্ন সময় শিক্ষার্থীদের আবাসন নিশ্চিত করার দাবিতে আন্দোলনে নামতে হচ্ছে।
গত বছরের ২৯ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এক নোটিশে অবৈধ শিক্ষার্থীদের সাত দিনের মধ্যে হল ছাড়ার নির্দেশ দেয়। ওই সময় কিছু শিক্ষার্থী হল ছেড়ে দিলেও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের হল থেকে বের করতে পারেনি প্রশাসন। অছাত্রদের কক্ষ থেকে বের করা, গণরুম বিলুপ্ত করা ও মিনি গণরুমে অবস্থান করা শিক্ষার্থীদের আসন নিশ্চিতের দাবিতে একই বছরের ১ জুন রাত থেকে টানা আট দিন অনশন করেন সামিউল ইসলাম নামের এক শিক্ষার্থী। পরে প্রশাসন অছাত্রদের হল বের করার আশ্বাস দিলেও আর কার্যকর হয়নি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের ৫১তম ব্যাচের এক শিক্ষার্থী প্রথম আলোকে বলেন, এক বছর পার হলেও এখনো হলে সিট পাননি। চার আসনবিশিষ্ট একটি কক্ষে আটজন মিলে থাকছেন। এতে পড়াশোনাসহ দৈনন্দিন কাজে নানা সমস্যায় পড়তে হচ্ছে।
আবারও হল ছাড়ার নির্দেশ
গত শনিবার রাতে মীর মশাররফ হোসেন হলের একটি কক্ষে স্বামীকে আটকে রেখে হল–সংলগ্ন জঙ্গলে এক নারীকে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে ছাত্রলীগ নেতা মোস্তাফিজুর রহমান ও বহিরাগত মামুনুর রশিদের বিরুদ্ধে। ছাত্রত্ব শেষ হওয়ার পরও হলে থাকছিলেন মোস্তাফিজুর। এরপর নতুন করে আবারও অবৈধ শিক্ষার্থীদের হল থেকে বের করার দাবি ওঠে। এমন অবস্থায় রোববার জরুরি সিন্ডিকেট সভায় পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে হলগুলো থেকে অবৈধ শিক্ষার্থী ও পোষ্য কোটায় ভর্তি শিক্ষার্থীদের বের করার সিদ্ধান্ত হয়। এ বিষয়ে বিজ্ঞপ্তিও দিয়েছে প্রশাসন। এবারও নির্দেশনা বাস্তবায়ন নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন শিক্ষার্থীরা।
তবে এবার নির্দেশনা বাস্তবায়ন করেই ছাড়বেন বলে জানিয়েছেন উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে অছাত্রদের হল থেকে বের করার নির্দেশ দিয়েছি। এবার যেটা বলেছি সেটা বাস্তবায়ন করেই ছাড়ব। আমাকে জাস্ট পাঁচটা দিন সময় দাও তারপর দেখো কী ব্যবস্থা নিই। হলে কোনো অছাত্র থাকবে না।’
প্রশাসন ছাত্রলীগের কাছে অসহায় অভিযোগ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী বলেন, ছাত্রলীগের অবৈধ শিক্ষার্থীদের প্রশাসন হল থেকে নামাতে ব্যর্থ এবং তাদের সদিচ্ছাও নেই। প্রশাসন ছাত্রলীগের সঙ্গে এক ধরনের মৈত্রী বানিয়ে রাখছে। ছাত্রলীগের সঙ্গে তারা নিয়োগ–বাণিজ্য করে। নিয়োগসংক্রান্ত সিদ্ধান্ত হয় ছাত্রলীগ এবং উপাচার্যের মধ্যে। এখানে টেন্ডারবাজি হচ্ছে, চাঁদাবাজি হচ্ছে। এসব অপরাধের দায়ভার নিতে হবে প্রশাসনকে। তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগসহ সব সংগঠনের উচিত ছাত্রত্ব শেষ হওয়া ব্যক্তিদের দিয়ে কমিটি না করা। এই সংস্কৃতি গড়ে তুলতে পারলে এ ধরনের সমস্যা থাকবে না। কারণ, ছাত্রলীগ অবৈধভাবে হলে থাকে পদ পাওয়ার জন্য।