বিশ্বম্ভরপুরে হাওরে ফসল রক্ষা বাঁধের কাজ শেষ হওয়ার আগেই ধস
জেলা প্রশাসক ও পাউবোর কর্মকর্তারা ক্ষতিগ্রস্ত স্থান দুটি পরিদর্শন করে দ্রুত কাজ করার নির্দেশনা দিয়েছেন সংশ্লিষ্টদের।
সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার বড় ধানের হাওর হলো খরচার হাওর। এই হাওরের ফসল রক্ষায় হাওরের পশ্চিম পাড়ের ঘটঘটিয়া নদের তীর ঘেঁষে বাঁধ নির্মাণের ১০টি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। উপজেলার রাধানগর থেকে দক্ষিণ দিকে একেবারে জিরাক তাহিরপুর গিয়ে শেষ হয়েছে এই বাঁধ। এসব প্রকল্পের কাজ এখনো শেষ না হলেও দুটি বাঁধে ধস দেখা দিয়েছে। এতে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন হাওরপারের কৃষকেরা।
সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক ও হাওরে বাঁধ নির্মাণসংক্রান্ত জেলা কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ রাশেদ ইকবাল চৌধুরী ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কর্মকর্তা ক্ষতিগ্রস্ত স্থান দুটি পরিদর্শন করে দ্রুত কাজ করার নির্দেশনা দিয়েছেন সংশ্লিষ্টদের।
স্থানীয় লোকজন জানান, খরচার হাওরের পশ্চিম পাড়ের ফসল রক্ষায় যে বাঁধ দেওয়া হয়, সেটির সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ স্থান হলো বেকা বাঁধ ও হরিমণের ভাঙা এলাকা। এবার বেকা বাঁধে আগে কাজ শুরু হলেও হরিমণের ভাঙায় কাজ শুরু হয়েছে দেরিতে। এখন মাটি ফেলার পর বাঁধ দুটির দুটি স্থানে ধস দেখা দিয়েছে। বাঁধের মাটি ধসে পড়েছে পাশের ঘগঘটিয়া নদে। স্থানটি গভীর হওয়ায় কাজ করাও এখন কঠিন হবে।
স্থানীয় কৃষকদের ভাষ্য, ২০১৭ সালে এই বেকা বাঁধ ভেঙে হাওরে ফসলহানি ঘটেছিল। এরপর ২০২০ ও ২০২১ সালে পানির তোড়ে বাঁধ ভাঙার উপক্রম হলে প্রশাসন, পাউবো ও স্থানীয় লোকজনের চেষ্টায় বাঁধ রক্ষা পায়। এবারের বন্যায় বেকা বাঁধ ঘেঁষে নদীতে গর্ত সৃষ্টি হওয়ায় বাঁধটি শুরু থেকেই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। বিষয়টি পাউবোর কর্মকর্তাদের আগেই জানানো হয়েছে।
বাঁধের কাজের দায়িত্বে থাকা লাকী মিয়া জানান, শুরুতে নদীতে পানি বেশি থাকায় বিষটি ধরা পড়েনি। পরে যখন পানি কমে তখন বোঝা যায়। কিন্তু প্রকল্প আগে হওয়ায় এটিতে আর বাড়তি বরাদ্দ ধরা হয়নি। পরে পাউবোকে অবহিত করলে তারাও সরেজমিনে দেখে। লাকী মিয়া বলেন, ‘আমরা কাজ ঠিকই করেছিলাম। কিন্তু নদীভাঙনের টানে বাঁধে ধস দেখা দিয়েছে। তবে আবার কাজ শুরু হয়েছে।’
বাঁধের পাশের গাছতলা এলাকার বাসিন্দা কৃষক আবদুল মালিক জানান, হাওরের বাঁধের সবচেয়ে ঝুঁকির জায়গা এটি। কিন্তু কাজ শুরু হয়েছে দেরিতে। আগে থেকেই চিন্তা করে বাঁধটা ঝুঁকিপূর্ণ স্থান থেকে কিছুটা পূর্বে সরিয়ে কাজ করানো উচিত ছিল। তাহলে এখন সমস্যা হতো না।
হাওরপারের রাধানগরের কৃষক কামাল উদ্দিন বলেন, বাঁধটি ধসে যাওয়ায় হাওরপারের কৃষকদের মধ্যে দুশ্চিন্তা ভর করেছে। দ্রুত শক্তভাবে আবার বাঁধের কাজ না করলে কৃষকের কপাল পুড়তে পারে।
জিরাক তাহিরপুর গ্রামের কৃষক জসিম উদ্দিন বলেন, বাঁধ কেবল পূর্ব দিকে সরালেই হবে না। নদীর ভাঙনও ঠেকাতে হবে। না হলে বাঁধ ভাঙার আশঙ্কা থেকেই যাবে। এখানে পাইলিং করে ভাঙন ঠেকিয়ে বাঁধের কাজ করতে হবে। নতুন বাঁধের মাটি শক্তকরণের কাজ করতে হবে ভালোভাবে।
কৃষ্ণনগরের স্বপন কুমার বর্মণ বলেন, মূল বাঁধের অর্ধেক অংশ নদীতে ধসে গেছে। এখন বাঁধ পূর্ব দিকে সরিয়ে যেভাবে মাটি দেওয়া হচ্ছে, সেভাবে মাটি টিকবে না। মাটি দুর্বল কম হচ্ছে। বাঁধ দুর্বল হয়ে ঝুঁকির মধ্যে থাকবে। নদীর পাড় ভাঙন ঠেকিয়ে যতটা সম্ভব সোজা করে করতে হবে বাঁধ। দ্রুত কাজ শেষ করে জিও ব্যাগ দিতে হবে দুটি ভাঙনেই। স্থানীয় কৃষকেরা জানান, খরচার হাওরে সুনামগঞ্জ সদর ও বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার কৃষকদের জমি রয়েছে। বাঁধে ধস দেখা দেওয়ায় কৃষকেরা চিন্তিত। এই বাঁধ দ্রুত সংস্কার না হলে পুরো হাওরের ফসল ঝুঁকিতে থাকবে বলে জানান তাঁরা।
সুনামগঞ্জ পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মামুন হাওলাদার মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখছি। কৃষকদের উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ নেই। আমরা বাঁধের দিক পরিবর্তন করে দ্রুত কাজ করার নির্দেশ দিয়েছি। কাজ শুরু হয়ে গেছে। এক সপ্তাহের মধ্যে কাজ শেষ হবে বলে আশা করছি।’
সুনামগঞ্জ পাউবো সূত্রে জানা গেছে, জেলার ১২টি উপজেলার ছোট–বড় ৯৫টি হাওরে প্রতিবছর সোয়া দুই লাখ হেক্টরের মতো জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়। এসব হাওরে বেড়িবাঁধ আছে ১ হাজার ৭১৮ কিলোমিটারের মতো। পাউবো কাজ করে ৩৮টি হাওরে। এবার ৫৯১ কিলোমিটার বেড়িবাঁধে ৭৩৫টি প্রকল্পে কাজ হচ্ছে। এতে প্রাক্কলন ধরা হয়েছে ১২৫ কোটি টাকা। পাউবোর দাবি, এখন পর্যন্ত ৬৭ শতাংশ কাজ হয়েছে। তবে হাওর বাঁচাও আন্দোলন সংগঠনের পক্ষ থেকে বলা হয়, এখনো অর্ধেক কাজও হয়নি।