হামলার দুই সপ্তাহ পরও আতঙ্কে যশোরের বাঘারপাড়ার হিন্দুরা
৫ আগস্ট সন্ধ্যায় যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার সুলতাননগর গ্রামের ঋষিপল্লিতে চলছিল সান্ধ্য পূজার আয়োজন। এলাকার দুই মন্দিরে চলছিল পূজার আনুষ্ঠানিকতা। এ সময়েই আসে হামলার খবর। ঋষিপল্লির লোকজন আতঙ্কে ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাতে শুরু করেন।
ওই পল্লির প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, ওই দিন শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে হিন্দুপল্লিটিতে হামলা করে ৪০ থেকে ৫০ জনের দল। তাদের প্রত্যেকের হাতে ছিল রামদা, হাঁসুয়া, লোহার রড, শাবল, লাঠির মতো দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র। প্রথমে তারা হামলা করে শশধর বিশ্বাসের বাড়িতে। তাঁর ঘরের টিনের দরজা দা দিয়ে কোপায়। একপর্যায়ে দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে জিনিসপত্র এবং বাঁশের তৈরি ডালা, কুলা, ঝুড়ি লুট করে।
শশধর বিশ্বাস বলেন, হামলাকারীরা বাড়িতে ঢুকে খুব গালাগাল করতে থাকে। এরপর ঘরে ঢুকে যা ছিল সব লুট করে নিয়ে যায়। আর যা নিতে পারেনি, তা ভেঙে ছড়িয়ে ফেলে। এখন খুব ভয় লাগে। রাতে ঠিকমতো ঘুম হয় না।
হামলার দুই সপ্তাহ পরও ঋষিপল্লির নারী-পুরুষ ও শিশুদের মধ্যে ভয় আর আতঙ্ক কমেনি। গত মঙ্গলবার সেখানে গিয়ে দেখা গেছে, ছেলেরা ৩০ জনের একটি দল গঠন করে রাত জেগে মন্দির ও বাড়িঘর পাহারা দিচ্ছেন। তবুও তাঁদের মন থেকে ভয় কিংবা আতঙ্ক শিগগির পালাচ্ছে না।
শশধর বিশ্বাসের বাড়িতে দেখা যায়, দুটি কক্ষের টিনের দরজায় বেশ কয়েকটি দায়ের কোপের চিহ্ন। একটি ঘরের মেঝেতে ছড়িয়ে আছে সিঁদুরের কৌটা, কুলা, তালপাখা, চায়ের কাপ, পানির মগ ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের কিছু টুকরা।
সেখান থেকে একটু সামনে গেলেই চোখে পড়ে পশুপতি বিশ্বাসের (৬৫) বাড়ি। তিনি বলেন, হামলার খবর পেয়ে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর স্ত্রী মণিমালা বিশ্বাস (৫৫) বাড়ি ছেড়ে যেতে পারেননি; উঠানেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। হামলার আকস্মিকতায় ভয় পেয়ে একসময় দৌড়ে ঘরে ঢুকতে যান। কিন্তু বারান্দায় উঠলে তাঁর কোমরে মুগুরের আঘাত আসে। এতে সেখানেই পড়ে যান তিনি। এরপর দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে স্বর্ণালংকার, নগদ টাকা এবং মালামাল লুট করে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা।
ওই হামলার পর মণিমালা বিশ্বাস রীতিমতো আতঙ্কগ্রস্ত। সেই সঙ্গে কোমরের আঘাতও সেরে ওঠেনি। ভয়ার্ত চোখে তিনি বলেন, ‘মুগুরের বাড়িতে পড়ে গেলে কয়েকজন মিলে রামদা দিয়ে কোপাতে যায়। অনেক কাকুতি-মিনতি করে রেহাই পেয়েছি। এখনো কোমরে ব্যথা আছে। হাঁটতে পারি না, শুতে পারি না। ভয়ে রাতে ঘুম আসে না।’
ওই হামলার পর থেকে ভয়ে আর হাটে যেতে পারেননি মণিমালার স্বামী পশুপতি। অথচ কয়েক দিন আগেও বাঁশ দিয়ে ডালা, কুলা, ঝুড়ি বানিয়ে পাশের ধলগ্রামের হাটে বিক্রি করতেন। কখনো জুতাও সেলাই করেছেন। কিন্তু এখন বাড়িতেই থাকেন। কারণ জানতে চাইলে পশুপতি জবাব দেন, ‘ঘরে থাকা ৪০ হাজার টাকাও নিয়ে গেছে ওরা। খেয়ে না খেয়ে বাড়িতে থাকতে হচ্ছে। খুব ভয়ে আছি।’
মন্দিরে হামলা
ঋষিপল্লির হিন্দুদের বসতভিটার পাশাপাশি মন্দির ও মণ্ডপেও হামলা-ভাঙচুর হয়েছে। ভাঙা হয়েছে বেশ কিছু প্রতিমা। সরেজমিন দেখা যায়, পল্লিটিতে কাছাকাছি অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে মোট চারটি মন্দির ও একটি মণ্ডপ। হরিচাঁদ মন্দিরের দুটি প্রতিমার একটির মাথা ভাঙা। পাশের বাসন্তী মন্দিরে ১১টি প্রতিমার মধ্যে সাতটির কোনোটির হাত, কোনোটির মুখ, আবার কোনোটির মাথা ভাঙা অবস্থায় আছে। আর পাশের মনসামন্দিরে হামলার একাধিক ক্ষতচিহ্ন। মনসামন্দিরের পাশের মণ্ডপের দুই পাশের টিনের বেড়া ভেঙে ফেলা হয়েছে।
ওই দিন সন্ধ্যায় হরিচাঁদ মন্দিরে পূজা দিচ্ছিলেন দীপালী বিশ্বাস (৬৮)। অন্যদের পালাতে দেখে পূজা শেষ না করে পালিয়ে যান তিনিও। তবে যাওয়ার সময় মন্দিরের গেটে তালা দিতে পারেননি। আর এতেই সেখানে তাণ্ডব চালায় দুর্বৃত্তরা। দীপালী বলেন, ‘সেদিন সন্ধ্যায় প্রাণটা নিয়ে পালিয়ে যেতে পেরেছি। কিন্তু মন্দিরে থাকা ঠাকুরকে রক্ষা করতে পারিনি। সেদিনের পর থেকে সন্ধ্যায় মন্দিরে পূজা দিতে ভয় লাগে।’
হামলার পাশাপাশি চলেছে লুটপাট
সুলতাননগর ঋষিপল্লিতে প্রায় ৯০টি পরিবারে পাঁচ শতাধিক মানুষের বসবাস। এদের অধিকাংশই দরিদ্র। তারপরও ১২টি বাড়িতে হামলার পর লুটপাট করা হয়েছে বলে জানান হরিচাঁদ মন্দির কমিটির সভাপতি নলিন চন্দ্র বিশ্বাস। তাঁর ভাষ্য, এসব ঘর থেকে শতাধিক হাঁস-মুরগি, একটি ছাগল, সোনাদানা, নগদ টাকা, চাল, ডাল, তেল, বাঁশের তৈরি ডালা কিংবা কুলা সামনে যা কিছু পেয়েছে, তা-ই নিয়ে গেছে। পল্লির একমাত্র গভীর নলকূপটিও খুলে নিয়ে গেছে হামলাকারীরা।’
নলিন চন্দ্রের অভিযোগ, হামলার এত দিন পরও প্রশাসনের কেউ তাঁদের খবর নিতে আসেনি। ফলে বাসিন্দারা এখনো আতঙ্কে আছেন।
রেহাই পায়নি খেলনাও
ঋষিপল্লির বাইরেও কয়েকটি হিন্দু বাড়িতে হামলা-লুটপাট চালানো হয়। এগুলোর একটি দীপংকর বিশ্বাসের বাড়ি। আন্ধারকোটা গ্রামের কাজলা নদীর তীরে ওই বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ঘরের বারান্দায় ভাঙা খেলনা নিয়ে খেলছে দীপংকর বিশ্বাসের তিন বছরের বয়সী ছেলে ঈশান বিশ্বাস। ঘরের পাশে দুটি হাঁস-মুরগির ঘর। একটি কোপের চিহ্ন নিয়ে উল্টে আছে।
দীপংকরের মা সবিতা রানী বিশ্বাস (৬৫) বলেন, হামলাকারীরা ঘরে-বাইরে যা কিছু পেয়েছে তা নিয়ে গেছে। যা নিতে পারেনি তা ভেঙে রেখে গেছে। ঘরে রাখা শিশুদের খেলনা পর্যন্ত ভেঙে ফেলেছে। দীপংকরের ছোট ছেলে ভাঙা খেলনা নিয়ে খেলে আর কাঁদে।
দীপংকরের বাবা ও ধলগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক সদস্য ক্ষিতিশ চন্দ্র বিশ্বাস (৭২) বলেন, ৫ আগস্ট রাত আটটার দিকে প্রায় ১৫০ জন লোক রামদা, হাঁসুয়া, লাঠি, শাবল, লোহার রড ও পেট্রল ভর্তি বোতল নিয়ে তাঁর বাড়িতে হামলা চালায়। ভাঙচুরের পর তারা বাড়ি থেকে চারটি গরু, ২২টি হাঁস, ১২টি মুরগি, ৪০টি হাঁসের ডিম, দুই বস্তা চাল ও একটি বৈদ্যুতিক মোটর নিয়ে যায়। হামলার সময় তিনি ও তাঁর স্ত্রী বাড়িতেই ছিলেন। দুর্বৃত্তরা তাঁদের কাছে এক লাখ টাকা দাবি করে। না দিলে ঘরের মধ্যে রেখে পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার হুমকি দেয়। ৫০ হাজার টাকা দিয়ে প্রাণে রক্ষা পেয়েছেন বলে তাঁর দাবি।
পুড়েছে নানা জিনিস
আন্ধারকোটা গ্রামে কাজলা নদীর তীর ঘেঁষেই গোলক চন্দ্র বিশ্বাসের (৫৬) বাড়ি। পেশায় কৃষক হলেও নিয়মিত ধর্মীয় গানবাজনা করেন। ৫ আগস্ট রাতে স্ত্রীকে নিয়ে বাড়িতেই ছিলেন। হঠাৎ রাত সাড়ে ১০টার দিকে টের পান বাড়ির পাশের সড়কে অবস্থান নিয়েছে শতাধিক ব্যক্তি। তাদের মধ্যে কয়েকজন বাড়ির ভেতরেও ঢুকছে। দেরি না করে দ্রুত ঘর থেকে বের হন গোলক ও তাঁর স্ত্রী। গোলক এক দৌড়ে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। খানিক বাদে সাঁতরে চলে যান ওপারে। কিন্তু বাড়ির ভেতরে আটকে পড়েন তাঁর স্ত্রী। সেখানে তাঁকে ধরে ফেলে হামলাকারীরা। দুর্বৃত্তদের একজন গোলকের স্ত্রীর ঘাড়ে রামদা ধরে রাখে। আর অন্যেরা তখন ঘরে প্রবেশ করে ভাঙচুর চালায়।
ঘটনার প্রসঙ্গে গোলক চন্দ্র বলেন, ‘আমি কোনো রাজনীতি করি না। দিনে কৃষিকাজ করি; রাতে ধর্মীয় গানবাজনা করি। তারপরও রেহাই পেলাম না। হামলার আট দিন পর বাড়ি ফিরেছি। দিনে দুজনে বাড়িতে থাকি। আর রাতে অন্য কোথাও থাকি। যদিও রাতে গ্রামের লোকজন পাহারা দেয়। তবুও ভয় কাটছে না।’
গোলকের দাবি, হামলাকারীরা ওই দিন ঘরে থাকা পারিবারিক ঠাকুরঘর ভাঙচুর করেছে। এ ছাড়া সোনা, নগদ ৫০ হাজার টাকা, একটি মিউজিক বক্স লুট করে। এরপর ঘরের বারান্দায় রাখা একটি মোটরসাইকেল ও একটি বাইসাইকেল বের করে বাড়ির উঠানের একপাশে রাখে। পরে ঘর থেকে কাঁথা, বালিশ ও কাপড়চোপড় বের করে মোটরসাইকেল ও বাইসাইকেলের ওপর রেখে আগুন ধরিয়ে দেয়।
গোলক চন্দ্র বিশ্বাসের বাড়িতে এসব ক্ষতচিহ্ন এখনো দগদগে। উঠানের এক পাশে পড়ে আছে মোটরসাইকেল আর বাইসাইকেলের কঙ্কাল। অন্য পাশে ঘরের টিনের বেড়ায় অসংখ্য কোপের চিহ্ন। বারান্দার বাঁশের বেড়া ভাঙা। ঘরের মধ্যে শোকেস ও আলমারির ভাঙা কাচ। আর ঠাকুরঘরে বিক্ষিপ্তভাবে পড়ে আছে পূজার উপকরণ।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, ওই রাতে নতুন গ্রামের স্বপন কুন্ডু, শেখর ঢালী, বল্লামুখ গ্রামের অরবিন্দু স্বর্ণালংকার, অমল স্বর্ণালংকার এবং মোহন্ত কুন্ডুর বাড়িতে হামলা ও লুটপাট করা হয়েছে।
‘তথ্য জানা নেই’
এতগুলো হামলা-লুটপাটের ঘটনার পরও থানায় কেউ কোনো অভিযোগ করেনি। এমনটিই দাবি করেছেন বাঘারপাড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. রোকিবুজ্জামান। তিনি বলেন, লিখিত অভিযোগ পেলে এ ব্যাপারে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ ব্যাপারে তথ্য নেই প্রশাসনের হাতেও। জানতে চাইলে বাঘারপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হোসনে আরা তান্নি বলেন, ‘আমাদের কাছে যে তথ্য আছে, তাতে বাড়িঘর ও মন্দিরে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট, প্রতিমা ভাঙচুর বা আগুন দেওয়ার কোনো তথ্য নেই। কোনো জনপ্রতিনিধিও আমাদের বিষয়টি জানাননি। এ ব্যাপারে খোঁজ নেওয়া হবে।’