কর্মচারী ছাড়া সরকারি এক শিশু হাসপাতাল 

সরকারের কেউ খোঁজ না রাখলেও ঝিনাইদহ শহর ও আশপাশের মানুষের কাছে সুনাম কুড়িয়েছে হাসপাতালটি। 

২৫ শয্যাবিশিষ্ট শিশু হাসপাতাল। ঝিনাইদহ শহরের বাস টার্মিনাল এলাকায়প্রথম আলো

২৫ শয্যার সরকারি শিশু হাসপাতালটিতে গড়ে রোগী থাকে ৫০ জনের বেশি। অথচ তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির একজন কর্মচারীও দেয়নি সরকার। মূলত স্থানীয় মানুষের সহায়তা নিয়ে হাসপাতালটি চলছে।

হাসপাতালটি ঝিনাইদহ শহরের। নাম ২৫ শয্যাবিশিষ্ট শিশু হাসপাতাল। শিশুদের হাসপাতাল হিসেবে ঝিনাইদহ শহর ও আশপাশের এলাকার মানুষের কাছে সুনাম কুড়িয়েছে। মানুষ আস্থাও রাখেন। তবে সিভিল সার্জন কার্যালয় বা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হাসপাতালটির ওপর নজর নেই। বারবার অনুরোধ করেও জনবল, যন্ত্রপাতি ও অর্থসহায়তা পান না এই ছোট হাসপাতালের কর্মকর্তারা।

এলাকার মানুষকে সম্পৃক্ত করে চৌগাছা উপজেলা হাসপাতাল পরিচালনার মাধ্যমে সুনাম কুড়িয়েছেন চিকিৎসক এমদাদুল হক। এ হাসপাতালের বিষয়ে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বহু মানুষ শিশুদের নিয়ে এই হাসপাতালে আসছেন। স্থানীয় মানুষ সহায়তা করছেন ঠিকই; কিন্তু সরকারেও তো কিছু দায়দায়িত্ব আছে। হাসপাতাল চালাবেন, অথচ একজনও কর্মচারী দেবেন না, এটা কি সম্ভব?’

সরেজমিন শিশু হাসপাতাল

লাল ইটের দোতলা ভবনের হাসপাতালটি ঝিনাইদহ শহরের বাস টার্মিনাল এলাকায় অবস্থিত। ১১ ডিসেম্বর বিকেলে সেখানে গিয়ে কথা হয় হাসপাতালের কনসালট্যান্ট আলী হাসান ফরিদ ও তাঁর কয়েকজন সহকর্মীর সঙ্গে। তাঁদের মিলিত চেষ্টায় হাসপাতালটি চালু আছে। 

 হাসপাতাল চত্বর পরিপাটি, সামনে আছে ফুলের বাগান। ভবনের ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়ে একটি ফলক। তাতে লেখা, ২০০৫ সালের ৭ মে এই হাসপাতালের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, এ ধরনের হাসপাতাল দেশে আর নেই।

বিভিন্ন ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা গেল, পর্যাপ্ত শয্যা আছে। শয্যাগুলোর গায়ে লেখা, কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সেগুলো দান করেছে।

কালীগঞ্জ উপজেলা থেকে আসা একজন নারী বললেন, তাঁর ১৮ মাসের শিশুর শ্বাসকষ্ট। প্রথম উপজেলা হাসপাতালে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে এখানে আসার পরামর্শ দেওয়া হয়। পাশের শয্যায় ছিলেন একজন অবস্থাপন্ন পরিবারের এক নারী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এই শহরের শিশুদের চিকিৎসায় এর চেয়ে ভালো হাসপাতাল আর নেই।

কলা বেচে অক্সিজেন

হাসপাতালে নানা সমস্যা নিয়ে চিকিৎসা নিতে আসা শিশুদেরও জন্য সারা বছর কৃত্রিম অক্সিজেনের দরকার হয়। চিকিৎসকেরা জানালেন, বছরে প্রায় সাড়ে তিন লাখ টাকার অক্সিজেন প্রয়োজন হয়। সরকারের কাছ থেকে সর্বোচ্চ দেড় লাখ টাকা পাওয়া যায়।   

কথা বলতে বলতে এই প্রতিবেদককে হাসপাতালের পেছন দিকের কলাবাগানে নিয়ে যান আলী হাসান। তিনি জানান, হাসপাতালের  পড়ে থাকা তিন বিঘার মতো জমিতে কলা চাষ করা হয়। কলা বিক্রি করে গত বছর আশি হাজার টাকার অক্সিজেন কিনেছেন। এ বছরও তা–ই করতে হবে।

যেভাবে চলছে হাসপাতাল

হাসপাতালে চিকিৎসকের পদ আছে পাঁচটি, নিয়মিত পদে আছেন তিনজন। আর তিনজন চিকিৎসক প্রেষণে কাজ করেন। ফার্মাসিস্ট, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট (রেডিওগ্রাফি), প্রধান সহকারী কাম হিসাবরক্ষক, অফিস সহকারী কাম ডাটা এন্ট্রি অপারেটর ও স্টোরকিপারের পদ খালি। নার্সের ২১টি পদের বিপরীতে আছেন ১৭ জন। এমএলএসএস, ওয়ার্ড বয়, আয়া, মশালচি, মালি, নিরাপত্তাপ্রহরী ও সুইপার—এসব পদই নেই।

যশোরের কিছু ব্যবসায়ী, কয়েকজন চিকিৎসক এবং আলী হাসান ফরিদের একাধিক বন্ধু অর্থ, শয্যা, যন্ত্রপাতি ও জনবল দিয়ে সহায়তা করছেন। ঝিনাইদহ পৌরসভা এবং জাহেদি ফাউন্ডেশন নিয়মিত সহায়তা করে। এ ছাড়া ১৫ জন কিছু সহায়তা দেন।

আলী হাসান বলেন, জনবল ও অন্যান্য সহযোগিতার জন্য সিভিল সার্জন এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল শাখায় অনেকবার আবেদন জানিয়েছেন। কিন্তু কাজ হয়নি। সর্বশেষ আবেদন জানিয়েছিলেন এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে। 

১৫ ডিসেম্বর সচিবালয়ে ওই শিশু হাসপাতাল নিয়ে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম ও স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব সাইদুর রহমানের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব প্রথম আলোকে বলেন, বিষয়টি তাঁর জানা নেই। তিনি খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।