বিরাট রাজার বাড়ি

বিরাট রাজার বাড়ির স্থাপনা, যা বুরুজ নামে পরিচিত। সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জে।ছবি: প্রথম আলো

সবুজে ঘেরা গ্রামটির নাম ক্ষীরতলা। এই গ্রামে দেখা মিলবে বহুপ্রাচীন কিছু নিদর্শনের ধ্বংসাবশেষের। কালের বিবর্তনে সেগুলো এখন ঢিবির রূপ নিয়েছে। আকার ও উচ্চতায় এই ঢিবিগুলোর একটি বিশাল। সেটিকে স্থানীয় লোকজন বলেন ‘বুরুজ’। এর আরেকটি পরিচয় রয়েছে—রাজবাড়ি বা বিরাট রাজার বাড়ি।

ক্ষীরতলা গ্রামটি সিরাজগঞ্জের রাজগঞ্জ উপজেলার ধামাইনগর ইউনিয়নে। এই উপজেলা নিয়ে রায়গঞ্জ: ইতিহাস, সমাজ ও সংস্কৃতি নামে একটি বই লিখেছেন যশোরের সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক খ ম রেজাউল করিম। তাতেও উঠে এসেছে এই বিরাট রাজার বাড়ির কথা।

বইয়ে রাজবাড়ির বর্ণনা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে, রায়গঞ্জের নিমগাছী হাটের উত্তর দিক দিয়ে প্রসারিত পুরোনো সড়ক ধরে মাইল দেড়েক আরও উত্তরে গেলে দেখা মিলবে কয়েকটি ঢিবির। সেগুলোর শেষ প্রান্তে রয়েছে বিশাল একটি ঢিবি। সেটি প্রায় দুই একর এলাকাজুড়ে বিস্তৃত। উচ্চতা ২৫ ফুট। ওই ঢিবিটিকেই বিরাট রাজার প্রাসাদ বলে অভিহিত করা হয়। এর চারপাশে পাঁচ একর জায়গাজুড়ে বেশ কয়েকটি ছোট-বড় ঢিবি রয়েছে। বোঝাই যায়, সুদূর অতীতে এখানে ভবন, মন্দির, দুর্গসহ বিভিন্ন স্থাপনার অস্তিত্ব ছিল।

২০১৮ সাল থেকে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক মো. রিফাত-উর-রহমানের তত্ত্বাবধানে ক্ষীরতলা গ্রামে প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান চলছে। সেখানে এখন পর্যন্ত ১৫টি প্রত্নস্থল শনাক্ত করা হয়েছে। রিফাত-উর-রহমান বলেন, এই প্রত্নস্থলগুলোর মধ্যে বিরাট রাজার বাড়ি, আমির আলীর ঢিবি, অর্জুনগড়, কাতলা পুকুর, শ্যামল দিঘি ও পাহাড় প্রতাপ অন্যতম।

প্রত্নস্থলের পরিমাপ ও নমুনা সংগ্রহ করে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে রিফাত-উর-রহমানের দল। এই নমুনাগুলোর মধ্যে অনেক মৃৎপাত্রের টুকরা, প্রাচীন ইট, তিনটি পোড়ামাটির ফলক উল্লেখযোগ্য। ফলক তিনটির মধ্যে একটি ধ্যানী গৌতম বুদ্ধের ভূমিস্পর্শমুদ্রা–সংবলিত। অপর দুটিতে রয়েছে বানরের মুখচ্ছবি ও সাপের ফণা। ধ্যানী বুদ্ধের তিন ধরনের মূর্তি দেখা যায়। এর মধ্যে পৃথিবী বা ভূমিস্পর্শী মূর্তিকে বলা হয় ভূমিস্পর্শমুদ্রা।

ক্ষীরতলার এই নিদর্শনগুলো কতটা প্রাচীন, জানতে চাইলে রিফাত-উর-রহমান বলেন, প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা অত্যন্ত জটিল ও সময়সাপেক্ষ বিষয়। খুব সহজে একটি প্রত্নস্থলের সময়পর্ব নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। তবে ছয় বছর ধরে করা সমীক্ষা থেকে বেশ তাৎপর্যপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। ক্ষীরতলার নিদর্শনগুলোর সঙ্গে মহাস্থানগড় ও পাহাড়পুরের প্রত্নবস্তুর তুলনামূলক পর্যবেক্ষণ চলছে। মহাস্থানগড়ে পাওয়া ইটের সঙ্গে ক্ষীরতলায় পাওয়া ইটের সাদৃশ্য রয়েছে। এ ছাড়া বুদ্ধের ভূমিস্পর্শমুদ্রা–সংবলিত পোড়ামাটির ফলকের মতো হুবহু ফলক পাহাড়পুরেও পাওয়া গেছে।

রিফাত-উর-রহমান বলেন, ‘এগুলো থেকে আমরা আপাতত ধারণা করছি, ক্ষীরতলার প্রত্নস্থলগুলো হয়তো পাল শাসনামলে গড়ে উঠেছিল। তবে এখনো যেহেতু খননকাজ শুরু হয়নি, তাই আমরা প্রত্নবস্তুগুলোর রেডিও-কার্বন পরীক্ষা করতে পারিনি। বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর অনুমতি দিলে আমরা ক্ষীরতলার প্রত্নস্থলগুলো খননের পর নমুনা সংগ্রহ করে রেডিও-কার্বন পরীক্ষা করতে চাই।’

নমুনাগুলোর মধ্যে অনেক মৃৎপাত্রের টুকরা, প্রাচীন ইট, তিনটি পোড়ামাটির ফলক উল্লেখযোগ্য
ছবি: প্রথম আলো

এর বাইরেও কিছু প্রশ্নের জবাব খুঁজছেন রিফাত-উর-রহমান। তিনি বলেন, স্থানীয়ভাবে পরিচিত বিরাট রাজার বাড়ি থেকে আনুমানিক ৪৫০ মিটার পূর্বে একটি নদীর মরা খাত পাওয়া গেছে। এটি মরা করতোয়া হিসেবে পরিচিত। অতীতে নৌপথে মহাস্থানগড়ের সঙ্গে ক্ষীরতলার যোগাযোগ ছিল কি না, এমন প্রশ্নের উত্তর জানা প্রয়োজন। বিষয়গুলো জানতে আরও দীর্ঘ সময় গবেষণা করতে হবে।

বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এরই মধ্যে বিরাট রাজার বাড়িকে সংরক্ষিত প্রত্নস্থল হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে। তবে এর আশপাশের অন্য প্রত্নস্থানগুলো বিলুপ্তির ঝুঁকির মুখে রয়েছে বলে জানান প্রত্নতাত্ত্বিক রিফাত-উর-রহমান। প্রত্নস্থলগুলো সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া জরুরি বলে মনে করেন তিনি। একই ভাষ্য নিমগাছী ডিগ্রি কলেজের সহকারী অধ্যাপক যোগেন্দ্রনাথ সরকারের। তিনি বলেন, কালের বিবর্তনে এ বুরুজের অনেক ক্ষতি হয়েছে। স্থানীয় লোকজনও কম ক্ষতি করেননি। এখনো যতটুকু আছে, তা সংরক্ষণ করা জরুরি।

  • সাজেদুল আলম, রায়গঞ্জ, সিরাজগঞ্জ