সেই হালিম পেলেন গোপালদী পৌরসভায় আওয়ামী লীগের মনোনয়ন
নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলার গোপালদী পৌরসভার মেয়র পদে মনোনয়ন পেয়েছেন তিন শিশুকে মারধরের পর দুই শিশুর চুল কেটে দেওয়ার অভিযোগ ওঠা আওয়ামী লীগ নেতা হালিম সিকদার।
গতকাল শনিবার গণভবনে আওয়ামী লীগের স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডের সভা শেষে বিভিন্ন নির্বাচনে দলীয় মনোনয়নপ্রাপ্তদের নামের তালিকা প্রকাশ করা হয়। সেই তালিকায় গোপালদী পৌর মেয়র পদে হালিম সিকদারের নাম আছে। এ ছাড়া আড়াইহাজার পৌরসভায় মেয়র পদে বর্তমান মেয়র সুন্দর আলী আবার দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন।
হালিম সিকদার আড়াইহাজার উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। ২০১৩ ও ২০১৮ সালের পর টানা তৃতীয়বারের মতো তিনি গোপালদী পৌরসভা মেয়র পদে দলীয় মনোনয়ন পেলেন। গত ৬ ফেব্রুয়ারি চুরির অভিযোগে তিন শিশুকে মারধরের পর গ্রাম ঘুরিয়ে দুই শিশুর চুল কেটে দেওয়ার অভিযোগে করা মামলার প্রধান আসামি হালিম সিকদার।
উপজেলা আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা যায়, হালিম সিকদার ছাড়াও উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মনির হোসেন, তথ্য গবেষণা সম্পাদক বেলাল হোসেন ও গোপালদী বাজার বণিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আওয়ামী লীগ নেতা আবুল মনসুর গোপালদী পৌরসভায় মেয়র পদে নির্বাচনের জন্য দলীয় মনোনয়ন চেয়েছিলেন। গতকাল টানা তৃতীয়বারের মতো দলের পক্ষ থেকে হালিম সিকদারের নাম ঘোষণা করা হয়।
তিন শিশুকে মারধরের পর দুই শিশুর চুল কেটে দেওয়ার বিষয়ে হালিম সিকদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই কাজ আমি করিনি। মামলার বাদী এবং শিশুদের পরিবারও আমার পক্ষে সাক্ষ্য দিয়েছে। মানুষ এগুলো বিশ্বাস করে না। ভোটের মাঠেও এর কোনো প্রভাব নেই।’
যদিও গত ৬ ফেব্রুয়ারি চুল কেটে দেওয়ার ঘটনাটিকে ‘শাসন’ দাবি করেছিলেন হালিম সিকদার। সে সময় প্রথম আলোকে তিনি বলেছিলেন, ‘আর যেন কেউ চুরি না করে, সে জন্য তাদের শাসনের পর সুন্দর করে চুল কেটে দিয়ে বাড়ি পাঠানো হয়েছে।’ ঘটনার পর নারায়ণগঞ্জ আদালতে এসে নারায়ণগঞ্জ-২ (আড়াইহাজার) আসনের সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম বাবুর শিশুদের চুল কেটে দেওয়ার ঘটনাকে ‘ওয়ান কাইন্ড অব শাসন’ বলে মন্তব্য করেছিলেন।
হালিম সিকদারকে শিশু নির্যাতনকারী উল্লেখ করে উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মনির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘হালিম সিকদার একজন চিহ্নিত শিশু নির্যাতনকারী। ৭, ৮ ও ১১ বছর বয়সী তিন শিশু খেলার ছলে একটি লোহার টুকরা হাতে নেওয়ায় তিনি ওই শিশুদের মারধরের পর হাত বেঁধে গ্রাম ঘুরিয়েছেন। পরে দুই শিশুর মাথার চুল কেটে দেন। শুধু তা–ই নয়, বিষয়টি কাউকে জানালে শিশুদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে গ্রামছাড়া করার হুমকিও দিয়েছেন তিনি। গণমাধ্যমের খবরে দেশ বিদেশের মানুষ বিষয়টি জেনেছে। আমরা প্রতিবেশী হিসেবে ঘটনার সবকিছু জানি। ফলে এমন একজন শিশু নির্যাতনকারীকে দলের প্রার্থী হিসেবে মেনে নিতে পারছি না। তাঁকে মনোনয়ন দেওয়ার খবর শুনে এলাকার ভোটাররাও হতভম্ব হয়ে গেছেন।’
পৌরসভায় স্থানীয় ব্যবসায়ী তানভীর হোসেন স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনের মাঠে আছেন। তিনি বলেন, ‘মাত্র দুই মাস আগেই এত বড় একটি ঘটনা ঘটল। স্থানীয় মানুষ বিষয়টি নিয়ে এখনো ক্ষুব্ধ। এরই মধ্যে এমন একজন ব্যক্তির আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পাওয়া দলের সমর্থক হিসেবে আমাদের জন্য হতাশার।’
গত ৬ ফেব্রুয়ারি সকালে চুরির অভিযোগে আড়াইহাজারে রামচন্দ্রদী বাজারে ৭, ৮ ও ১১ বছর বয়সী তিন শিশুকে মারধরের পর হাত বেঁধে গ্রাম ঘুরিয়ে দুই শিশুর মাথার চুল কেটে দেওয়া হয়। এ ঘটনার পরদিন নির্যাতনের শিকার এক শিশুর বাবা বাদী হয়ে গোপালদী পৌরসভা মেয়র ও উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হালিম শিকদারসহ চারজনের নাম উল্লেখ করে এবং চার থেকে পাঁচজনকে অজ্ঞাতনামা আসামি হিসেবে আড়াইহাজার থানায় একটি মামলা করেন। পুলিশ মামলার দুই আসামিকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠায়। এ ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশের পর থেকে ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যদের মামলা ও হামলার হুমকি দেওয়ার অভিযোগ উঠে মেয়রের বিরুদ্ধে। জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে ঘটনার তদন্ত করা হয়। মেয়রের বিরুদ্ধে করা মামলাটি পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি) তদন্তের ভার নেয়।
নারায়ণগঞ্জ জেলা গোয়েন্দা পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) তাপস কান্তি রায় মামলাটির বর্তমান তদন্ত কর্মকর্তা। তিনি বলেন, ‘মেয়রসহ মামলার সব আসামি এখন জামিনে আছেন। আমরা শিগগিরই মামলাটির তদন্ত প্রতিবেদন দেব।’
এ দিকে হালিম সিকদার আবার দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার পর নির্যাতনের শিকার শিশুদের পরিবার বিষয়টি নিয়ে আতঙ্কে আছে। নাম না প্রকাশের শর্তে দুই শিশুর তিন স্বজন বলেছেন, বিষয়টি নিয়ে তাঁরা শঙ্কিত। কিন্তু কোথাও কথা বলতে পারছেন না।
এক শিশুর স্বজন বলেন, ‘মামলা করার পর এক দিনের জন্যও তিনি (মেয়র) গ্রেপ্তার হননি। এখন উল্টো তাঁকে আবারও মেয়র পদে আওয়ামী লীগের প্রার্থী করা হয়েছে। আমরা আর এই ঘটনার বিচার চাওয়ার সাহস পাচ্ছি না।’
হালিম সিকদারকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ঘোষণার বিষয়টি দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেছেন শিশু সংগঠন খেলাঘর আসরের সাবেক কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক জহিরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘মেয়র থাকা অবস্থায় তিনটি শিশুকে মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতন করেছেন। নির্যাতনের শিকার শিশু এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের মাধ্যমে আমরা সে কথা জেনেছি। এমন একজন ব্যক্তিকে আওয়ামী লীগের মতো একটি দলের মেয়র প্রার্থী ঘোষণা করা দুঃখজনক। এতে শিশু নির্যাতনকারীরা আরও উৎসাহিত হবে। সমাজে শিশুদের ওপর ক্ষমতার অপব্যবহার বাড়বে।’