ময়মনসিংহে বন্যাদুর্গত এলাকায় স্বাস্থ্যঝুঁকি, অনেকেই ভুগছেন জ্বর ও চর্মরোগে
এক বছর বয়সী আদিবা সুলতানার শরীরজুড়ে চুলকানি। লালচে হয়ে গেছে শরীর। তার মা আসমা বেগমের (৩৫) শরীরেও একই অবস্থা। বন্যার পানিতে মায়ের শরীর থেকে ছোট্ট আদিবার শরীরেও ছড়িয়েছে রোগ। দিনমজুর বাবা শফিকুল ইসলামের পক্ষে তাঁদের চিকিৎসা করানো সম্ভব হচ্ছে না। তাই মেয়েকে নিয়ে আসেন বন্যাদুর্গত এলাকায় সেনাবাহিনী পরিচালিত মেডিকেল ক্যাম্পে। চিকিৎসা ও ওষুধ নিয়ে বাড়ি যান তাঁরা। ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট উপজেলার ধারা ইউনিয়নের গাঙ্গিনারপাড় গ্রামে তাঁদের বাড়ি।
৩ অক্টোবর ভারী বর্ষণ ও উজানের পাহাড়ি ঢলে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট ও ধোবাউড়া উপজেলার ৯টি ইউনিয়নের ৫৩টি গ্রাম প্লাবিত হয়। বন্যার পানি ধীরগতিতে নামছে। টানা ১০ দিনের বেশি সময় পানিতে থাকার কারণে পানিবাহিত চর্মরোগের দেখা দিয়েছে শিশু ও বয়স্ক মানুষের মধ্যে। অসহায় এসব মানুষের চিকিৎসার জন্য ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প করছে সেনাবাহিনী। আজ সোমবার হালুয়াঘাটের ধারা উচ্চবিদ্যালয় মাঠে রোগীদের ব্যবস্থাপত্র ও বিনা মূল্যে ওষুধ বিতরণ করা হয়েছে।
বেলা ১১টার দিকে ধারা স্কুলের মাঠে গিয়ে দেখা যায় চিকিৎসা নিতে আসা শিশু ও বয়স্ক মানুষের ভিড়। তাঁদের মধ্যে চর্ম, জ্বর ও ঠান্ডাজনিত রোগী বেশি। ত্রাণ নিতেও এসেছেন অনেকে। দুপুর ১২টার দিকে সদর দপ্তর আর্মি ট্রেনিং অ্যান্ড ডকট্রিন কমান্ডের ভারপ্রাপ্ত জিওসি মেজর জেনারেল এ কে এম নাজমুল হাসান মেডিকেল ক্যাম্পেইনের কার্যক্রম পরিদর্শন করেন এবং বন্যার্তদের মধ্যে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করেন।
সাত বছর বয়সী জান্নাতুলের মা মারা গেছেন। বাবা আল আমিন বিয়ে করে নতুন সংসারে। দাদা রফিকুল ইসলাম কলা বিক্রি করে নাতনিকে দেখাশোনা করেন। বন্যার পানিতে হাঁটাহাঁটি করে জান্নাতুলের পায়ের চামড়ায় রোগ দেখা দিয়েছে। চুলাকানিতে ঘায়ের মতো হয়ে গেছে। নাতনিকে চিকিৎসক দেখাতে আসা রফিকুল বলেন, বাড়ির উঠানে এখনো পানি। পানির কারণে রোগ দেখা দিয়েছে।
ধরাবাজার কলোনিতে বসবাস করেন বৃদ্ধ রইছ উদ্দিন। পানিতে থাকার কারণে তাঁর জ্বর ও শ্বাসকষ্ট দেখা দিয়েছে। চিকিৎসা নিতে এসে লাইনে দাঁড়িয়ে কাঁপছিলেন তিনি। রইছ উদ্দিন বলেন, ‘আইজ চাইর দিন ধইরা জ্বরে ভুগতাছি। দম নিতে পারতাছি না, খুব কষ্ট অইতাছে। দুই ছেলে থাকলেও তারা দেখে না।’ নাগলা গ্রামের ছালেমন বেগম (৭০) আসেন ত্রাণ নিতে। তিনি বলেন, ‘বন্যায় কোমরসমান পানি ছিল। বাড়িতে চুলায় অহনও পানি। চিড়ামুড়ি খাইয়া বাঁইচা আছি। চুলাত রাইন্দা খাইবার পাই না।’
হেলেনা বেগম (৬৫) ভিক্ষা করে জীবন চালান। সাত বছর আগে তাঁর স্বামী মারা গেছেন। নিজের কোনো সন্তান নেই। থাকেন অন্যের বাড়িতে। যে বাড়িতে থাকেন, সেখানেও ছিল কোমরপানি। ঘরে পানি থাকায় পাঁচ দিন ধারা ইউনিয়ন পরিষদে থাকার পর গত শুক্রবার বাড়ি ফিরেছেন। পানিতে ঘোরাঘুরির কারণে তাঁর চর্মরোগ দেখা দিয়েছে। চিকিৎসক দেখিয়ে ওষুধ কিনে খাওয়ার সামর্থ্য নেই তাঁর। বিনা মূল্যে চিকিৎসক দেখিয়ে ওষুধ নিয়ে বাড়ি ফেরার সময় বলছিলেন, ‘চুলকানির যন্ত্রণায় ভুগছিলাম। এখন যদি কিছুটা কমে।’
গৃহহীন পরিবারের মধ্যে ঢেউটিন–টাকা বিতরণ
হালুয়াঘাটের কৈচাপুর ইউনিয়নের জামগড়া গ্রামের ছফুরা খাতুনের দুটি ঘরে ভেঙে গেছে বন্যায়। সেনাবাহিনী তাঁকে বাড়ি করার জন্য ঢেউটিন ও ১০ হাজার দিয়েছে। ছফুরা বলেন, ‘ঘরগুলা ভাইঙ্গা নেওনের পর খুব চিন্তায় আছিলাম। থাহনের কোনো জায়গা নাই। অহন নয়া ঘর তুলবাম।’
হালুয়াঘাট উপজেলা টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারে (টিটিসি) স্থাপিত সেনাক্যাম্পে ৫০টি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মধ্যে গৃহনির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় ঢেউটিন ও অর্থ সহায়তা করেছে সেনাবাহিনী। কৈচাপুর ইউনিয়নের শাকুয়াই গ্রামের আবদুল কাইয়ুম (৭০) দিনমজুরি করে সংসার চালান। ছেলেরা দেখে না। তাঁর একটি ঘর ভেঙে গেছে বন্যায়। তিনি বলেন, ‘নতুন টিন ও ঘর করার জন্য টাকা পেয়েছি। বন্যায় ঘর হারালেও নতুন একটা ঘর করা যাবে।’
সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, বন্যার শুরু থেকেই সেনাবাহিনীর আর্মি ট্রেনিং অ্যান্ড ডকট্রিন কমান্ডের অধীন ৪০৩ ব্যাটল গ্রুপ নীরবচ্ছিন্নভাবে বন্যার্তদের উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করে আসছে। বন্যাকবলিত বিভিন্ন স্থানে আটকে থাকা অসহায় মানুষদের উদ্ধার করে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে এবং তাদের মধ্যে মানবিক সহায়তা চলমান রয়েছে।
বন্যার্তদের সহায়তার লক্ষ্যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কর্তৃক আজ একটি মেডিকেল ক্যাম্প আয়োজন করা হয়। সদর দপ্তর আর্মি ট্রেনিং অ্যান্ড ডকট্রিন কমান্ডের ব্যবস্থাপনায় এবং ৪০৩ ব্যাটল গ্রুপের আয়োজনে পরিচালিত এই ক্যাম্পে হালুঘাটের প্রায় ৮০০ জন দরিদ্র ও দুস্থ ব্যক্তিকে বিনা মূল্যে চিকিৎসা ও ওষুধ সরবরাহ করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দল এই ক্যাম্পের মাধ্যমে স্থানীয় মানুষদের জরুরি স্বাস্থ্যসেবা দিয়েছে। এখন পর্যন্ত সদর দপ্তর আর্টডকের অধীন ৪০৩ ব্যাটল গ্রুপ কর্তৃক ময়মনসিংহে ৩৬৯ জনকে উদ্ধার, ২ হাজার ৪৫০ প্যাকেট ত্রাণ বিতরণ এবং ১ হাজার ৮০০ মানুষকে বিনা মূল্যে চিকিৎসা সহায়তা করা হয়েছে।