সেই ঘাগড়া স্কুলেই ঋতুপর্ণাদের অপেক্ষায় তৃষা, অপর্ণারা
বাঁ প্রান্ত থেকে থ্রোটা ঋতুপর্ণার পায়ে পড়ল। প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়কে বোকা বানিয়ে গোলমুখে ঋতুর আড়াআড়ি শট। সঙ্গে সঙ্গে গোল বলে চিৎকার করে উঠল ঘাগড়া উচ্চবিদ্যালয়ের একঝাঁক মেয়ে। ‘ঋতু ঋতু’ , ‘মনিকা মনিকা’—বলে তাদের বাঁধভাঙা উল্লাস। পাহাড়ের রাতের নির্জনতা ভেঙে সেদিন বিজয়ের উল্লাসে ফেটে পড়ে ঋতু-মনিকার উত্তরসূরিরা।
বলছিলাম ৩০ অক্টোবর রাতে নেপালে অনুষ্ঠিত দক্ষিণ এশিয়ায় মেয়েদের শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই সাফ ফুটবলের ফাইনালের দৃশ্যের কথা। সেদিন দশরথ স্টেডিয়ামভর্তি নেপালি দর্শকদের স্তব্ধ করে দিয়ে স্বাগতিকদের বিপক্ষে জয়গাথা রচনার মূলে ছিলেন এই ঋতুপর্ণা ও মনিকা চাকমা। দুজনের পা থেকেই আসে বাংলাদেশ দলের গোল দুটি। পাহাড়ি এই দুই কন্যার জন্য শিরোপাটিকে একটু বেশি নিজেদের মনে হয় রাঙামাটির ঘাগড়া উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের। তাই তো এত উল্লাস-উন্মাদনা পূর্বসূরিদের কৃতিত্বে।
হ্যাঁ ঋতুপর্ণা চাকমা, মনিকা চাকমা, রূপনা চাকমারা এই স্কুলের শিক্ষার্থী। ফুটবলের পাঠ পেয়েছেন তাঁরা এই স্কুল থেকেই। ঘাগড়া উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠের প্রতিটি ঘাস ও ধূলিকণা তাঁদের চেনা। সেই পথ ধরেই এখানে প্রমীলা ফুটবল আলো ছড়াচ্ছে। এখানে লেখাপড়ার পাশাপাশি এক যুগ ধরে চলছে নারী ফুটবলার তৈরির কাজ।
এখন ৩২ জন মেয়ে ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে তাদের প্রশিক্ষণ চালিয়ে যাচ্ছে। দুটি কক্ষে গাদাগাদি করে তাদের বসবাস। কত স্বপ্ন তাদের চোখেমুখে। এই যেমন তৃষা চাকমার কথাই ধরা যাক। তিন বোনের মধ্যে বড় সে। সবে রাঙামাটি ঘাগড়া স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেছে। এখন পাশের কলেজে পড়ে। তাঁর চেতনাজুড়ে কেবল ফুটবল।
বাবা কৃষক। ঠিকমতো খাবারের টাকা দিতে পারে না; কিন্তু মেয়েদের ইচ্ছার দাম তিনি হয়তো দিয়েছেন নিজের সবটুকু দিয়ে। নইলে কি আর তৃষার ছোট দুই যমজ মেয়েকেও ফুটবলার হওয়ার জন্য বড় বোনের পথে পাঠান!
তৃষার যমজ বোন আমিষা ও মনিষাও দুই বছর হলো ঘাগড়া স্কুলে আছে। তৃষা বলেন, ‘আমরা ফুটবলার হতে চাই। ঋতুদি কিংবা মনিকা দির মতো জাতীয় দলে খেলতে চাই।’
ঘাগড়া উচ্চবিদ্যালয়ের নামটি ফুটবলের কারণেই। এখানে শুধু রাঙামাটি নয়, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি থেকেও মেয়েরা ফুটবলের টানে ছুটে আসে। যেমন বান্দরবানের মাফুচিন মারমা অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। সে বলে, ‘বাবা কৃষক। অনেক কষ্ট করে আমাদের সংসার চলে; কিন্তু আমাকে এখানে পাঠিয়েছে ফুটবলার হওয়ার জন্য।’
খাগড়াছড়ির চিন্তাদেবী ত্রিপুরা দশম শ্রেণিতে পড়ে। ডিফেন্স তার পজিশন। সে দেশসেরা রক্ষণভাগের খেলোয়াড় হওয়ার স্বপ্ন দেখে।
তবে তাদের এই স্বপ্নের পথটা কতটা যে অমসৃণ তা চোখে না দেখলে বোঝা যাবে না। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে স্কুল প্রাঙ্গণেই এই উঠতি ফুটবলারদের সঙ্গে কথা হয়।
তারা সকালের অনুশীলন শেষ করে সবে নিজেদের কক্ষে গিয়ে স্নান সেরেছে। কক্ষ বলতে আর কী, দুটি টিনের ছাউনি ঘরে গাদাগাদি করে তাদের আবাসন। বারান্দায় খেলার সরঞ্জাম—বুট, মোজা, জার্সি ইত্যাদি শুকাতে দেওয়া হয়। কক্ষের মধ্যে আসবাব বলতে কয়েকটি চৌকি। এই দুটি কক্ষেই তাদের থাকতে হয়। আরেকটি কক্ষে চলে রান্নাবান্না। তা–ও নিজেদের রান্না করে খেতে হয়। নিজেদের টাকায় তা করতে হয়।
সপ্তম শ্রেণির মিসতুই মারমা বলে, ‘আমাদের বাড়ি থেকে রান্নার জন্য টাকা দেওয়া হয়। সব সময় পাঠাতে পারে না। তখন খুব কষ্ট করে চলতে হয়।’
এই ৩২ জন আবাসিক খেলোয়াড়ের শুধু দুই বেলার চালটা আসে রাঙামাটি জেলা প্রশাসকের দপ্তর থেকে। অন্যান্য খরচ, বিশেষ করে তরিতরকারি, ডিম, খেলার সরঞ্জামের জন্য তাকিয়ে থাকতে হয় নিজ নিজ বাড়িতে।
অথচ এখান থেকেই উঠে এসেছে জাতীয় পর্যায়ের জাতীয় ফুটবলার। ঋতুপর্ণা, রূপনা, মনিকা, আনাই মগিনি, আনু চিন মগিনিরা ২০১৩ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত এই স্কুল থেকে প্রশিক্ষণ পেয়েছেন। রূপনা এখনো পড়ছেন। তারপর তাঁরা জাতীয় পর্যায়ে পৌঁছেছেন।
সেই ইতিহাস তুলে ধরলেন ঘাগড়া উচ্চবিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক শশীমনি চাকমা। তিনি বলেন, ২০১১ সালে বঙ্গমাতা গোল্ডকাপ ফুটবলে নজর কাড়ে এখানকার মগাছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মেয়েরা। তারা চ্যাম্পিয়ন হয়। এর মূলে ছিলেন প্রধান শিক্ষক বীরসেন চাকমা। এরপর ২০১৩ সালে মেয়েদের দল গঠন করা হয়। বাংলাদেশ স্কুল মাদ্রাসা গ্রীষ্মকালীন ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। ২০১৩ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত টানা রানার্সআপ হয় ঘাগড়া উচ্চবিদ্যালয়ের মেয়েরা।
এরপর ২০১৬ সালে ঘাগড়া উচ্চবিদ্যালয় চ্যাম্পিয়ন হয় ওই প্রতিযোগিতায়। ওই সময় থেকে ঋতুপর্ণা, মনিকা, আনু, রূপনারা এখানে আছে। ২০১৭ সাল থেকে আরও পাঁচবার রানার্সআপ হয় বিদ্যালয়টি। নিজ উদ্যোগে আবাসিক কক্ষ দুটি চালু করে ক্যাম্প করে ২০১৬ সাল থেকে।
শশীমনি বলেন, অনেক কষ্ট করে ক্যাম্প চালাতে হয়। একজন কোচ রয়েছেন। বল লাগে বছরে ১০০টির বেশি। মেয়েদের বুট, সরঞ্জাম আরও কত কী রয়েছে। শুধু চালটা পাওয়া যায়। বাকিগুলো মাঝেমধ্যে কেউ সহযোগিতা করে। খাবারের বিষয়টা বেশির ভাগ সময় মেয়েদের বাড়ি থেকে এনে চালাতে হয়।
এভাবে অর্ধাহার–অনাহারে ৩২ সদস্যের এই দলের প্রত্যেকেই স্বপ্ন বুনছে। কেউ রূপনার মতো দেশসেরা গোলকিপার হতে চায়, কেউ নিজেকে মণিকার মতো গড়ে তুলতে সচেষ্ট। দুই বার সাফজয়ী বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল তাদের কাছে এখন বড় প্রেরণা। তার অগ্রভাগে রয়েছেন পাহাড়ের কন্যারা।
প্রতিদিন ভোরে কোচ শান্তিমণি চাকমা মেয়েদের নিয়ে মাঠে নেমে পড়েন। এবড়োখেবড়ো মাঠ। তার পরও ফুটবল হওয়ার ইচ্ছায় যেন কোনো ক্লান্তি নেই।
শান্তিমনি চাকমা বলেন, ২০১৬ সালে স্কুল-মাদ্রাসা গ্রীষ্মকালীন ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয় এই স্কুলের ফুটবল দল। এভাবে দলটির সেরা মেয়েদের জাতীয় পর্যায়ে খেলার ডাক আসতে শুরু করে। পর্যায়ক্রমে ঋতু, মনিকারা জাতীয় দলে ডাক পায়; কিন্তু তাদের পুষ্টি কোথায়? কোথায় তাদের পেটভরে দুইবেলা খাওয়া? শুধু ঋতুদের চিন্তা করলে তো হবে না। চিন্তা করতে হবে তাদের উত্তরসূরিদেরও। আজ যদি তারা ভালোমতো পুষ্টি পায়, তাহলে ভবিষ্যতে আরও আরও ঋতু মনিকা বের হবে।
মেয়েদের কোনো টুর্নামেন্ট নেই জেলা বিভাগ পর্যায়ে—এটাও তাঁকে পোড়ায়। পোড়ায় আরও অনেক কিছু। অনেক অব্যবস্থাপনা। কলসিন্দুরের মতো ঘাগড়া স্কুলটির সরকারীকরণ না হওয়ার আক্ষেপও শোনা যায় শিক্ষকদের মুখে। তবু মেয়েদের ফুটবলার হিসেবে তৈরি করার অদম্য ইচ্ছা এই শান্তিময় চাকমাদের মধ্যে।
শান্তিময় বলেন, শুধু চ্যাম্পিয়ন হলে সবাই সংবর্ধনা দিতে ছুটে আসে। সবাই আতুড়ঘরের খোঁজ নিতে আসে। এরপর কোনো খবর নেই। ২০২২ সালে চ্যাম্পিয়নের পর কিছুদিন সবাই খোঁজ নিয়েছিল। এরপর বন্ধ। এখন নতুন করে সবাই খোঁজ নিচ্ছে। কিন্তু একটা কাঠামো দিতে হবে স্কুলে। স্কুলটিতে সেই ফুটবল ফ্যাসিলিটিসগুলো যদি না দিতে পারি, তাহলে ফুটবলার আসবে না।
কোচের মতো চাওয়া এই কন্যাদেরও। অপুষ্টি আর দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে তাদের স্বপ্ন এগিয়ে যাচ্ছে। তৃষা, অপর্ণা, জয়ারা তাকিয়ে আছে ভবিষ্যতের দিকে।
সামনের সপ্তাহে আঁতুড়ঘরে পা রাখতে যাচ্ছেন সাফজয়ী ঋতু, মনিকা, রূপনারা। দেওয়া হবে সংবর্ধনা। তাঁদের সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে উত্তরসূরিরা। স্বপ্নপূরণে তারকা ফুটবলারের সান্নিধ্যও যে খুব দরকার।