স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা হত্যা
আ.লীগ নেতাদের ভূমিকায় ক্ষোভ
কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা পৌর স্বেচ্ছাসেবক লীগের আহ্বায়ক সঞ্জয় কুমার প্রামাণিকের শেষকৃত্য গতকাল সাতবাড়িয়া এলাকায় অনুষ্ঠিত হয়।
কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা পৌর স্বেচ্ছাসেবক লীগের আহ্বায়ক সঞ্জয় কুমার প্রামাণিককে (৩৭) হত্যার ঘটনা কোনোভাবেই মানতে পারছেন না সাধারণ কর্মীরা। তাঁরা বলছেন, সঞ্জয়ের সঙ্গে যুবজোট নেতা মোস্তাফিজুরের যখন বিরোধ সৃষ্টি হয়, বিষয়টি উপজেলার আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের জানানো হয়েছিল। বিষয়টি নিয়ে বৈঠকও হয়েছে। তবে শীর্ষ নেতারা ছিলেন উদাসীন। এর মধ্যেই হত্যার ঘটনা ঘটে গেল। ভেড়ামারা শহরে দলীয় কয়েকজন নেতার কথায় এসব জানা গেছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ভেড়ামারা সাতবাড়িয়া এলাকায় শ্মশানে সঞ্জয়ের শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শামীমুল ইসলাম, সাবেক সভাপতি ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আকতারুজ্জামানসহ কয়েকজন শীর্ষ নেতা ছিলেন। এ ছাড়া সেখানে ভেড়ামারা উপজেলা যুবজোটের সহসভাপতি ও পৌর মেয়র আনোয়ারুল কবিরও ছিলেন। আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে হেসে কথাও বলছিলেন তিনি।
শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সাধারণ কয়েকজন কর্মী ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এক কর্মী বলেন, সঞ্জয়ের সঙ্গে মোস্তাফিজের বিরোধ মেটানোর জন্য নেতাদের বলা হয়। এমনকি জাসদ ও আওয়ামী লীগ নেতারা মিলে একটা বৈঠকও করেছিলেন। কিন্তু নেতারা বিষয়টি এড়িয়ে যান। কোনো কোনো নেতা বলেছিলেন, ‘যা হয় হোক, ওরা ওরা বুঝে নিক।’
এ সময় উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শামীমুল ইসলাম ওই কর্মীকে ‘সঞ্জয়প্রেমী’ উল্লেখ করে বলেন, ‘কোন নেতা বলেছিল তাঁর নাম বল?’ এরপর ওই কর্মী বলেন, ‘মনে করেন আপনি।’ এরপর আরও কয়েকজন কর্মী একই সুরে ক্ষোভের কথা বলেন। এক কর্মী শামীমুলের উদ্দেশে বলেন, ‘প্রেমিক ওইভাবে বইলেন না ভাই, প্রেম আপনিও কম জানেন না।’
জটলা হয়ে নেতা-কর্মীদের বাগ্বিতণ্ডা চলার সময় সেখানে সাংবাদিকেরা ভিডিও ধারণ করছিলেন। কয়েক মিনিট পর সাংবাদিকদের ধমক দিয়ে ভিডিও ধারণ বন্ধ করে দেওয়া হয়। বেলা একটার দিকে সঞ্জয়ের শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। এরপর নেতা-কর্মীরা যে যাঁর মতো চলে যান।
এর আগে বুধবার রাত ১১টার দিকে ঢাকা থেকে সঞ্জয়ের লাশ ভেড়ামারা শহরে গোডাউন মোড় এলাকায় বাড়িতে পৌঁছায়। রাতেই লাশ দেখতে ভিড় করেন আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। রাত ১২টার দিকে কুষ্টিয়া থেকে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ ভেড়ামারায় যান। তিনি সঞ্জয়ের বাবা দুলাল প্রামাণিককে সান্ত্বনা দেন। এ সময় আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা-কর্মীরা সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
এরপর হ্যান্ডমাইকে উপস্থিত নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে মাহবুব উল আলম বলেন, ‘সকালে লাশ সৎকার করে প্রার্থনা করতে হবে এবং একটা প্রতিবাদ সভা করতে হবে। এই প্রতিবাদ সভায় প্রশাসনকে আলটিমেটাম দিতে হবে, যাতে দ্রুত এ মামলার সঙ্গে সম্পৃক্ত যাঁরা, তাঁদের আইনের আওতায় এনে বিচারকাজ শুরু করা হয়। আমরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে এর বিচার করব।’
কাউকে আর হট্টগোল না করার আহ্বান জানিয়ে মাহবুব উল আলম বলেন, ‘কেউ আমরা আইন নিজের হাতে তুলে নেব না। কেউ আমরা কোনো হট্টগোল করব না। ইনশা আল্লাহ, এর বিচার হবে। আমি কুষ্টিয়াতে আছি। যেকোনো বিষয়ে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। সবার সঙ্গে যোগাযোগ হচ্ছে। যেকোনো সমস্যা হলে আমাকে জানাবেন।’
স্থানীয় লোকজন জানান, কাচারীপাড়ায় একটি মন্দিরে পূজার সময় মেলা পরিচালনা নিয়ে সঞ্জয়ের সঙ্গে মোস্তাফিজের বিরোধ বাড়তে তাকে। সাম্প্রতিক সময়ে মোস্তাফিজুরের এক ভাই মারধরের শিকার হন। অভিযোগ ওঠে, এতে সঞ্জয়ের হাত ছিল। এ নিয়ে বিরোধ আরও তুঙ্গে ওঠে। এরই ধারাবাহিকতায় ২ আগস্ট রাত ১১টার দিকে ভেড়ামারা উপজেলা খাদ্যগুদাম এলাকায় পূর্ববিরোধের জেরে পৌর স্বেচ্ছাসেবক লীগের আহ্বায়ক সঞ্জয় কুমার প্রামাণিকসহ তিনজনকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে ও গুলি করে গুরুতর আহত করা হয়। গত বুধবার সকাল সাড়ে আটটার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান সঞ্জয়। তিনি সেখানে ছয় দিন ধরে চিকিৎসাধীন ছিলেন।
হামলার পরপরই ৪ আগস্ট সঞ্জয়ের স্ত্রী বীথি রানী দে বাদী হয়ে যুবজোট নেতা মোস্তাফিজুর রহমানকে প্রধান আসামি করে ভেড়ামারা থানায় মামলা করেন। মামলায় ১৪ জনের নাম উল্লেখের পাশাপাশি ১০ থেকে ১২ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়। মামলায় প্রধান আসামি মোস্তাফিজুরসহ পাঁচজন বর্তমানে কারাগারে আছেন। অন্যরা জামিন নিয়েছেন।
ভেড়ামারা উপজেলা পূজা উদ্যাপন পরিষদ আগামী শনিবার সকাল ১০টায় ভেড়ামারা প্রেসক্লাবের সামনে বিক্ষোভ ও মানববন্ধন করবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। সংগঠনটির সভাপতি অমর চাঁদ কুণ্ডু। এ ছাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শামীমুল ইসলাম বলেন, তাঁদের সভাপতি রফিকুল আলম ঢাকায় অবস্থান করছেন। তিনি এলে শুক্রবার সিদ্ধান্ত নিয়ে বিক্ষোভ-সমাবেশ করা হবে।
এদিকে কুষ্টিয়া শহরে গতকাল বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা-কর্মীরা। দুপুরে শহরের এনএস রোডে মিছিল শেষে মজমপুর ট্রাফিক মোড়ে গিয়ে নেতারা বক্তব্য দেন। যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক স্বপন হোসেন বলেন, ‘জাসদ গণবাহিনীর সন্ত্রাসীরা সঞ্জয়কে হত্যা করেছে। এর কঠিন জবাব দিতে পারি। কিন্তু আইনকে সম্মান করি। স্বেচ্ছাসেবক লীগ যদি চায়, এক ঘণ্টার মধ্যে এই সন্ত্রাসীদের কুষ্টিয়াছাড়া করতে পারি।’
ছাত্রদল থেকে যুবজোটে মোস্তাফিজুর
সঞ্জয় হত্যা মামলার প্রধান আসামি মোস্তাফিজুর রহমান ওরফে শোভন ১০ বছর আগে ছাত্রদল করতেন। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন জেলা জাসদের সাধারণ সম্পাদক ও ভেড়ামারার বাসিন্দা আবদুল আলীম ওরফে স্বপন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ছাত্রদল থেকে মোস্তাফিজুর জাসদ ছাত্রলীগে যোগ দেন। এরপর জাসদের সহযোগী সংগঠন জাতীয় যুবজোটের নেতা হন। তবে সাম্প্রতিক সময়ে তিনি খুবই বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। কাউকে মানতে চাইতেন না। এ জন্য তাঁকে তেমন একটা দলের কার্যক্রমে রাখা হতো না।