সৌরবিদ্যুতের সড়কবাতিতে আলো ঝলমলে প্রত্যন্ত গ্রাম
গ্রামের বাড়িগুলোতে বিদ্যুৎ আছে অনেক দিন থেকেই, তবে সেখানে কোনো সড়কবাতি ছিল না। সন্ধ্যা হলেই গ্রামের রাস্তাগুলো ডুবে যেত অন্ধকারে। অনেকে এই অন্ধকারে হেঁটেই চলাচল করেন। কেউ টর্চলাইটের আলো ফেলে হাটবাজার থেকে কাজ শেষে বাড়ি ফেরেন।
তবে মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার নিজবাহাদুরপুর ইউনিয়নের ইটাউরী গ্রামের সড়কগুলোর সেই অন্ধকার এখন পুরোনো ইতিহাস। এখন সন্ধ্যা হলেই গ্রামের পথে পথে আলো জ্বলে ওঠছে। সড়কবাতির আলোয় দিনের মতো উজ্জ্বল হয়ে ওঠছে পথ। এই আলো জ্বালাতে গ্রামের প্রবাসীদের উদ্যোগে স্থাপিত হয়েছে সৌরবাতি। সড়ক থেকে সরে গেছে অন্ধকার। নিশ্চিন্ত ও স্বাচ্ছন্দ্যে পথ চলছেন ইটাউরীর লোকজন।
৫ কিলোমিটারে ৮৪টি সৌরবাতি স্থাপন করা হয়েছে। প্রতিটি খুঁটিতে ১৬৫ ওয়াটের ১টি প্যানেল, ৩০ ওয়াটের বাতি এবং ৩৪ এমপিআরের ব্যাটারি আছে। এতে খরচ হয়েছে ৩৩ লাখ টাকা।
ইটাউরী গ্রামের অনেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন। জীবন-জীবিকার টানে সাত সমুদ্র তেরো নদী পার হয়ে গেলেও ভুলে যাননি তাঁদের মাতৃভূমিকে। যেকোনো দুর্যোগ বা সমস্যায় তাঁরা গ্রামের মানুষের পাশেই থাকেন, স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাহায্য করেন। যুক্তরাজ্যে গঠিত ‘ইটাউরী হেল্পিং হ্যান্ডস, ইউকে’ নামের একটি সংগঠনের ব্যানারে প্রবাসীরা বন্যার সময়, করোনাকালে গ্রামবাসীর দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। সহযোগিতার এই ধারা এখনো অব্যাহত রেখেছেন তাঁরা। গ্রামে চুরি-ডাকাতি রোধ, সৌন্দর্য বৃদ্ধি ও আলোকিত করতে ইটাউরী হেল্পিং হ্যান্ডসের উদ্যোক্তারা সড়কবাতি স্থাপনের উদ্যোগ নেন। নানা দেশে ছড়িয়ে থাকা প্রবাসীরা এগিয়ে আসেন এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে।
স্ট্রিট লাইট স্থাপন প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে দেশে-বিদেশে দুটি কমিটি গঠন করা হয়। একটি গঠন করা হয় যুক্তরাজ্যে। সেই কমিটিতে ইটাউরী হেল্পিং হ্যান্ডস, ইউকের সভাপতি আবদুস সালামকে আহ্বায়ক করে সাত সদস্যবিশিষ্ট স্ট্রিট লাইট স্থাপন কমিটি এবং অপরটি দেশে (ইটাউরীতে) আবদুর রহমানকে সভাপতি করে ১৮ সদস্যবিশিষ্ট ইটাউরী স্ট্রিট লাইট বাস্তবায়ন কমিটি গঠন করা হয়। গত ১০ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে এই সৌরবাতি স্থাপন কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন নিজবাহাদুরপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান ময়নুল হক। এ সময় উপস্থিত ছিলেন ইটাউরী হেল্পিং হ্যান্ডস, ইউকের সভাপতি আবদুস সালাম। ২০ মার্চ সৌরবাতি স্থাপনের কাজ শেষ হয়।
‘ইটাউরী-দৌলতপুর থেকে বিহাইডহর’ সড়কের দুই কিলোমিটার এবং গ্রামের ভেতরের ছয়টি গলিপথের তিন কিলোমিটারসহ মোট পাঁচ কিলোমিটারে সৌরবাতি স্থাপন করা হয়েছে। এই ৫ কিলোমিটারে ৮৪টি সৌরবাতি রয়েছে। প্রতিটি খুঁটিতে ১৬৫ ওয়াটের ১টি প্যানেল, ৩০ ওয়াটের বাতি এবং ৩৪ এমপিআরের ব্যাটারি আছে। এতে খরচ হয়েছে ৩৩ লাখ টাকা।
ইটাউরী স্ট্রিট লাইট বাস্তবায়ন কমিটির সহসভাপতি এনাম উদ্দিন গত মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘এত দিন সড়কগুলো অন্ধকারে ডুবে রইছে। মানুষ অন্ধকারে চলাফেরা করেছে। এখন আর সেই অন্ধকার নেই। দূর থেকে আমাদের গ্রামকে (ইটাউরী) একটি দৃষ্টিনন্দন গ্রাম মনে হয়। প্রতিটি সৌরবাতি খুব ভালো ও ক্লিয়ার আলো দিচ্ছে। সৌরবাতি লাগানোতে খুবই আনন্দিত গ্রামের মানুষ।’
এনাম উদ্দিন জানান, গ্রামের এক পাশে রয়েছে সোনাই নদ। সেদিকে জনবসতি কম হলেও গ্রামের সৌন্দর্যের জন্য সোনাই নদের পাড়ে আরও দুই কিলোমিটারে সৌরবাতি স্থাপন করা হবে।
ইটাউরী গ্রামের প্রায় ৪০০ মানুষ ইউরোপ-আমেরিকা, কানাডাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাস করেন। ইটাউরী হেল্পিং হ্যান্ডস, ইউকে শাখার ব্যানারে সড়কবাতি স্থাপন হলেও বিভিন্ন দেশে থাকা গ্রামের সব প্রবাসীরাই এতে সহায়তা করেছেন। গ্রামে কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে। এর মধ্যে আছে ইটাউরী হাজী ইউনুছ মিয়া মেমোরিয়াল উচ্চবিদ্যালয়, ইটাউরী মহিলা আলিম মাদ্রাসা ও ইটাউরী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এ ছাড়া আছে একটি কেজি স্কুল ও কমিউনিটি ক্লিনিক।
নিজবাহাদুরপুর ইউপির চেয়ারম্যান ময়নুল হক প্রথম আলোকে বলেন, প্রবাসীদের আর্থিক সহযোগিতায় স্থানীয় লোকজন কাজটি বাস্তবায়ন করেছেন। ইটাউরী গ্রামজুড়ে এখন রাতে বাতি জ্বলে। এটা ভালো একটা উদ্যোগ, ভালো কাজ। সরকারের পাশাপাশি ব্যক্তি উদ্যোগে এ রকম কাজ প্রশংসনীয়।