মংডুর পরিবেশ দেখে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে আশাবাদী বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের জেলা শহর মংডুর সর্বত্র রোহিঙ্গাদের দোকানপাট। সেখানে নির্বিঘ্নে ব্যবসা-বাণিজ্য করছেন রোহিঙ্গা মুসলিম নারী–পুরুষেরা। দোকানের বিক্রেতাদের অধিকাংশই মুসলিম মেয়ে। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত দোকানে গিয়ে কেনাকাটা করছেন।
গতকাল শুক্রবার কক্সবাজারের আশ্রয়শিবিরে থাকা ২০ জনের একটি রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদল মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য পরিদর্শন করে। উদ্দেশ্য, প্রত্যাবাসন উপযোগী পরিবেশ সেখানে আছে কি না, তা দেখা। তাঁদের সঙ্গে যাওয়া বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের সদস্যরা পরিবেশ দেখে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। রাখাইনের পরিবেশ–পরিস্থিতি অনেক ভালো দাবি করে তাঁরা বলছেন, ছয় বছর আগে রাখাইন রাজ্যের বিভিন্ন এলাকা থেকে আট লাখের বেশি রোহিঙ্গা নাফ নদী অতিক্রম করে বাংলাদেশ আশ্রয় নিলেও মংডু শহরের রোহিঙ্গাদের নড়চড় হয়নি।
রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (যুগ্ম সচিব) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘মংডু শহরে আমরা ঘুরেছি, গ্রামেও গিয়েছি। সেখানকার রোহিঙ্গাদের সঙ্গেও আমাদের কথা হয়েছে, পরিবেশ অনেক ভালো। মংডু শহরে রোহিঙ্গা অবাধে ঘুরছে-কাজকর্মে ব্যস্ত রয়েছেন। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে আমরা আশাবাদী।’
গতকাল সকাল সাড়ে ৯টার দিকে টেকনাফ পৌরসভার চৌধুরীপাড়ার নাফ নদীর জেটি থেকে দ্রুতগতির জলযান নিয়ে রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদলের সদস্যরা রাখাইন রাজ্যে রওনা দেন। মাত্র ৪৫ মিনিটের মাথায় নাফ নদী অতিক্রম করে দলের সদস্যরা পৌঁছান মংডুর নাকফুরা খালের জেটিতে। সেখান থেকে রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদলের সদস্যদের বিভিন্ন গ্রাম ও পুনর্বাসনের জন্য নির্মিত মডেল ভিলেজসহ প্রত্যাবাসনের নানা অবকাঠামো দেখানো হয়। বিকেলে প্রতিনিধিদলের সদস্যদের মংডু শহর ঘুরে দেখানো হয়। শহরের বিভিন্ন মার্কেট ও বিপণিকেন্দ্রে সেখানকার মগ সম্প্রদায়ের পাশাপাশি রোহিঙ্গা নারী–পুরুষেরাও দোকানপাট, ব্যবসা–বাণিজ্য পরিচালনা করতে দেখে অভিভূত হন বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের সদস্যরা।
রোহিঙ্গাদের সহায়তার জন্য দলের সঙ্গে ছিলেন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সরকারি একাধিক সংস্থার আরও সাতজন সদস্য। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের জন্য মংডুর অদূরে পুনর্বাসনের জন্য তৈরি হচ্ছে ‘মডেল ভিলেজ’। এসব ‘মডেল ভিলেজও’ ঘুরে দেখানো হয়েছে রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদলকে।
প্রত্যাবাসন ঘিরে মিয়ানমারে প্রস্তুতি এবং পরিবেশ দেখে সন্তুষ্ট রাখাইন রাজ্য ঘুরে আসা সরকারি সংস্থার একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, মংডু শহরের পরিস্থিতি দেখে তিনি অভিভূত হয়েছেন। সেখানে রোহিঙ্গা মেয়েদের স্বাধীনভাবে ব্যবসা পরিচালনা করতে দেখেছেন তিনি। মংডুর মডেল ভিলেজ বাংলাদেশের আশ্রয়শিবিরের তুলনায় অনেক উন্নত। মডেল ভিলেজের যাঁরা থাকবেন, তাঁদের প্রত্যেক পরিবারে (রোহিঙ্গা) চাষাবাদের জন্য আড়াই কানি (এক একর) করে জমি বরাদ্দ দেওয়া হবে, স্কুলে রোহিঙ্গা ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার সুযোগ, চাকরি ও স্বাধীনভাবে ব্যবসা–বাণিজ্য করার সুযোগ থাকছে। মডেল ভিলেজে হাসপাতাল, মসজিদ ও খেলার মাঠ রাখা হচ্ছে, যা অতীতে রোহিঙ্গা বসতিতে ছিল না। রোহিঙ্গাদের উচিত সুযোগটি কাজে লাগানো।
পরিদর্শনের সময় মংডু ট্রানজিট কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠকে মংডু জেলা প্রশাসক বলেন, বাংলাদেশ থেকে ফিরে আসা রোহিঙ্গাদের মংডু ট্রানজিট কেন্দ্রে মাত্র তিন দিন রাখা হবে। তারপর সরাসরি মডেল ভিলেজে স্থানান্তর করা হবে। তখন মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতিস্বরূপ রোহিঙ্গাদের এনভিসি (ন্যাশনাল ভেরিফিকেশন সার্টিফেকেট) দেওয়া হবে। পর্যায়ক্রমে এনআইডি (জাতীয় পরিচয়পত্র) প্রদান করা হবে।
অবশ্য রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদলের কয়েকজন সদস্যরা এনভিসির বিরোধিতা করে এনআইডি (জাতীয় পরিচয়পত্র) এবং মডেল ভিলেজের পরিবর্তে জন্মভিটাতে (রোহিঙ্গাদের ফেলে যাওয়া বাড়িঘরে) রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের দাবি জানান।
রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদলের একজন সদস্য মো. ইলিয়াছ (৪৫) বলেন, এখন মিয়ানমার চাইছে, অতিথি হিসেবে রোহিঙ্গাদের ফেরাতে। কিন্তু রোহিঙ্গারা এনভিসির মাধ্যমে অতিথি হয়ে ফিরতে রাজি হবে না, নাগরিকত্ব দিয়ে প্রত্যাবাসন শুরু করতে হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেকজন রোহিঙ্গা বলেন, রাখাইন পরিস্থিতি বুঝতে হলে প্রত্যাবাসনে কিছু রোহিঙ্গার সাড়া দেওয়া উচিত। কক্সবাজার থেকে কিছু রোহিঙ্গা রাখাইনে গেলে অবস্থা জানা যাবে। না গেলে জানা হবে না, সংকটের নিরসন ঘটবে না। কিন্তু শঙ্কার কারণ হচ্ছে, উখিয়া-টেকনাফের আশ্রয়শিবিরগুলোয় প্রত্যাবাসনবিরোধী সশস্ত্র গোষ্ঠীর তৎপরতা রয়েছে। প্রায় প্রতিদিন একাধিক সশস্ত্র গোষ্ঠীর মধ্যে গোলাগুলি ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। তাতে সাধারণ রোহিঙ্গারা আতঙ্কিত।
রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদলের সদস্য মোহাম্মদ তাহের (৪৫) বলেন, মংডু শহরের পরিবেশ ভালো হলেও গ্রামের পরিবেশ–পরিস্থিতি খারাপ রয়েছে। তাই বলে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে বসে থাকলেও চলবে না। মংডুতে রোহিঙ্গাদের স্বাধীন ব্যবসা–বাণিজ্য এবং মডেল ভিলেজ প্রতিষ্ঠার বিষয়ে কক্সবাজারের আশ্রয়শিবিরে থাকা রোহিঙ্গাদের সচেতন করা গেলে প্রত্যাবাসন জোরদার হতে পারে।
বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১২ লাখ। এর মধ্যে ৮ লাখ এসেছে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর কয়েক মাসে রাখাইন রাজ্য থেকে। রোহিঙ্গা ঢলের ছয় বছরেও একজন রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি। যদিও এর আগে দুবার প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও রোহিঙ্গাদের অনীহার কারণে তা ভন্ডুল হয়েছিল।
আরআরআরসি মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, ‘মংডু শহরে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা ব্যবসা–বাণিজ্য চালাচ্ছেন স্বাধীনভাবে। আমরা তাঁদের সঙ্গে কথা বলেছি, নিরাপত্তা নিয়েও তাঁরা শঙ্কাতে নেই। যতটুকু জেনেছি মংডুতে ৮০ শতাংশ রোহিঙ্গা মুসলমানের বসবাস। এমন পরিস্থিতি বাংলাদেশের আশ্রয়শিবিরে থাকা রোহিঙ্গাদেরও জন্মভিটা রাখাইনে ফিরে যেতে উৎসাহিত করবে।’