চট্টগ্রামে এক বছরে আলুর দাম বেড়েছে ৩০ শতাংশ, পাঁচ বছরে ১৩৭ শতাংশ

চট্টগ্রামের বাজারে আলুর দাম কমছে না। গত শুক্রবার দুপুরে নগরের ষোলশহর কর্ণফুলী কমপ্লেক্স কাঁচাবাজারেছবি: জুয়েল শীল

চট্টগ্রামের খুচরা বাজারে এক বছরে গড়ে প্রায় ৩০ শতাংশ বেড়েছে আলুর দাম। জানুয়ারি মাসে এ সময়ে প্রতি কেজি আলুর দাম ছিল গড়ে ৬০ টাকা। অন্যদিকে গতকাল শনিবার বাজারে আলু বিক্রি হয়েছে ৭৫ টাকায়। চলতি বছরে চট্টগ্রামে এটিই আলুর সর্বোচ্চ গড় দাম। বাজারে আলুর মূল্যবৃদ্ধিতে সঠিক বাজার ব্যবস্থাপনা, বাজারে তদারকি, উৎপাদন তথ্যে গরমিল এবং ফলন নষ্ট হওয়াকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

চট্টগ্রাম নগরে পাঁচটি প্রধান কাঁচাবাজার ঘুরে দেখা গেছে, বাজারে পুরোনো আলু বিক্রি হচ্ছে গড়ে ৭০ টাকায়। অন্যদিকে নতুন আলু বিক্রি হচ্ছে ৯০ থেকে ৯৫ টাকা দরে। নগরের বহদ্দারহাট, চকবাজার, দুই নম্বর গেট, কাজীর দেউড়ি ও চৌমুহনী কাঁচাবাজারে এ দাম দেখা গেছে। অন্যদিকে সবজির বৃহৎ আড়ত রিয়াজউদ্দিন বাজারে পুরোনো আলু ৭০ ও নতুন আলু ৮২ টাকায় বিক্রি হয়েছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসেবে, চট্টগ্রামে এই অর্থবছর প্রায় ৩ হাজার ৯২৫ হেক্টর জমিতে আলুর আবাদ করা হচ্ছে। এর মধ্যে ১ হাজার ৩০ হেক্টরে আলুর আবাদ হয়েছে গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত। এক হেক্টরে গড়ে ১৩ টন আলু উৎপাদিত হয় বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। সে হিসেবে, চট্টগ্রামে এবারের লক্ষ্যমাত্রা ৫১ হাজার টনের বেশি। এদিকে গত জুলাই মাস থেকে ডিসেম্বরের শুরু সপ্তাহ পর্যন্ত প্রায় দেশে ৫৬ হাজার টনের বেশি আলু আমদানি করা হয়েছে বলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সূত্রে জানা গেছে।

আড়তদারেরা বলছেন, আলুর উৎপাদনের সঙ্গে চাহিদার গরমিল রয়েছে। চাহিদা অনুপাতে আলু এলেই দাম কমে যায়। কয়েক বছর আগেও আলু বিক্রি করতে না পেরে ব্যাপারীরা ফেলে দিয়েছেন। অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিতে চাহিদা ও জোগানের মধ্যে সামঞ্জস্য প্রয়োজন। এ ছাড়া কৃষক পর্যায় থেকে ক্রেতার হাতে পৌঁছানো পর্যন্ত সরকারি তদারকি বৃদ্ধি প্রয়োজন।

রিয়াজউদ্দিন বাজার আড়তদার কল্যাণ সমিতির সভাপতি রশীদ আহমেদ সওদাগর বলেন, আলুর উৎপাদন বাস্তবে কম হয়েছে। কিন্তু সরকারি সংস্থাগুলো আলু মজুত রয়েছে বলে ব্যবসায়ীদের হয়রানি করেন। দাম স্বাভাবিক রাখতে সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রয়োজন। উৎপাদন বেশির খবরে ব্যবসায়ীরাও আমদানিতে উৎসাহ পান না।

দাম বেড়েছে বছর বছর

কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের হিসাব বলছে, চট্টগ্রামের বাজারে আলুর দাম গত পাঁচ বছরে প্রায় ১৩৭ শতাংশ বেড়েছে। ২০২০ সালেও খুচরা বাজারে আলুর দাম ছিল গড়ে ২৮ থেকে ২৯ টাকা। সর্বোচ্চ দাম ছিল ৪৫ টাকা। পরের বছর দাম কমে ২০ থেকে ২৫ টাকার আশপাশে চলে আসে। তবে ২০২৩ সালের শেষের দিকে আলুর দাম ৫০ টাকার বেশি হয়ে যায়। এর পর থেকে মূলত বাজারে আলুর দর বেশি।

ব্যবসায়ীরা জানান, আলু সাধারণ তাপমাত্রায় বেশি দিন ভালো থাকে না। এ জন্য পণ্যটি সংরক্ষণের জন্য হিমাগারে রাখা হয়। সাধারণত নভেম্বরের শুরুতে নতুন আলু আসা শুরু করে। ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে সরবরাহ পুরো স্বাভাবিক হয়ে যায়। এরপর ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাস নাগাদ হিমাগারে আলু সংরক্ষণ শেষ হয়। এ বছর বন্যার কারণে আগেই সরবরাহ কমে গেছে। এ কারণে বাজারে দাম বেশি।

চট্টগ্রামে জ্যেষ্ঠ কৃষি বিপণন কর্মকর্তা শাহরিয়ার আকুঞ্জী প্রথম আলোকে বলেন, চট্টগ্রামের চাহিদা নিয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। এ বছর এখনো দেশীয় আলু মাঠ থেকে তোলা হয়নি। দাম কমাতে চট্টগ্রামের চারটি হিমাগারের বীজ আলুও খাওয়ার আলু হিসেবে বিক্রি করা হয়েছে। ডিসেম্বরের শেষের দিকে দাম স্বাভাবিক হবে কিছুটা।

আমদানিতেও দাম কমেনি

চট্টগ্রামে যে আলু উৎপাদিত হয়, তা দিয়ে চট্টগ্রামের চাহিদা পূরণ হয় না বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। তাঁদের ভাষ্য, এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন জেলা থেকে আলু চট্টগ্রামে সরবরাহ করা হয়। এর বড় একটি অংশ আসে মুন্সিগঞ্জ থেকে। দেশের আলু উৎপাদন গত কয়েক বছর কমেছে। সম্প্রতি বন্যায় এ বছর আলুর ফলন নষ্ট হয়েছে। তবে সরকারি হিসেবে প্রতিবছরই আলুর উৎপাদন শুধু বাড়ে।

বিবিএসের সবশেষ হিসাবে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে আলুর উৎপাদিত হয়েছে ১ কোটি ৪ লাখ ৩২ হাজার টন। আগের অর্থবছরের তুলনায় উৎপাদন বেড়েছে আড়াই লাখ টনের বেশি। ২০১৮-১৯ থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছরে আলুর উৎপাদন হিসাব করে দেখা যায়, গড়ে প্রতি অর্থবছরের আলুর উৎপাদন ছিল ৯৯ লাখ ৪৫ হাজার টন। তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, আলু উৎপাদনের এ তথ্যে গরমিল রয়েছে।

এদিকে আলুর দাম কমাতে এ বছর আলু আমদানি করেছের ব্যবসায়ীরা। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) হিসাবে দেখা যায়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আলু আমদানি হয়েছে ৯৮ হাজার ৭৩১ টন। একই সময়ে আলু রপ্তানি হয়েছে ১২ হাজার ৩৫২ টন। অর্থাৎ রপ্তানির প্রায় আট গুণ আলু আমদানি হয়েছে। তবে এরপরও বাজারে দাম কমেনি। বরং প্রতি সপ্তাহে দাম বেড়েছে।

চাক্তাই শিল্প ও ব্যবসায়ী সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আহসান খালেদ বলেন, চাহিদার কোনো হিসাব সরকারি কর্মকর্তারা দিতে পারেন না। উৎপাদনের যে হিসাব দেন, সে অনুযায়ী আলু বাজারে আসে না। অনুমাননির্ভর একটা হিসাব দেন তাঁরা। বাজারে সংকট তৈরি হলেও দাম বেড়ে যায়। সংকট যাতে তৈরি না হয়, সে জন্য সুনির্দিষ্ট উৎপাদন ও চাহিদার তথ্য প্রয়োজন।