কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও শিক্ষক সমিতির দ্বন্দ্বে ভুগছেন শিক্ষার্থীরা
উপাচার্য-শিক্ষক সমিতির দ্বন্দ্বের কারণে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় টানা ২৬ দিন ধরে বন্ধ। শিক্ষক সমিতির দাবি, উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয় চালাতে পারছেন না। উপাচার্যের দাবি, শিক্ষক সমিতির কারণেই বিশ্ববিদ্যালয়ে সংকট তৈরি হয়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬ হাজার ৯২৪ জন শিক্ষার্থীকে খেসারত দিতে হচ্ছে। সবার একটাই প্রশ্ন, কবে খুলবে বিশ্ববিদ্যালয়।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, গত ১৯ ফেব্রুয়ারি বিকেলে উপাচার্য এ এফ এম আবদুল মঈনের সঙ্গে তাঁর দপ্তরে শিক্ষক সমিতির নবনির্বাচিত নেতাদের সৌজন্য সাক্ষাৎ অনুষ্ঠান চলছিল। এই সময় উপাচার্যের সামনে বিভিন্ন দাবি তোলেন শিক্ষক সমিতির নেতারা। তখন উপাচার্য ও শিক্ষক সমিতির নেতাদের সঙ্গে বাগ্বিতণ্ডা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী ছাত্রলীগ নেতারা, কর্মকর্তা সমিতির সভাপতি ও প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যরা উপাচার্যের পক্ষ নিয়ে বাগ্বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন। এ সময় শিক্ষকদের হেনস্তা করার অভিযোগ ওঠে।
এই ঘটনার প্রতিবাদে শিক্ষক সমিতি ও কর্মকর্তা কমিটির সভাপতি সদর দক্ষিণ মডেল থানায় পাল্টাপাল্টি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। পরবর্তীকালে শিক্ষক সমিতি তিন দফা দাবি জানায়। এর মধ্যে গত ৬ মার্চ শিক্ষক সমিতি ব্যবস্থাপনা শিক্ষা বিভাগের প্রভাষক নিয়োগ পরীক্ষা ভন্ডুল করে দেয়। এরপর শিক্ষক সমিতি সাত দফা দাবি দেয়। ১৯ থেকে ২৭ মার্চ পর্যন্ত শিক্ষক সমিতি ক্লাস বর্জন করে। এরপর পবিত্র ঈদুল ফিতরের ছুটি শুরু হয়। ২১ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয় খোলা হয়। কিন্তু দাবি পূরণ না হওয়ায় শিক্ষক সমিতি ২৩ এপ্রিল পর্যন্ত কোনো ধরনের ক্লাস নেয়নি। ২৪ এপ্রিল উপাচার্য জরুরি সিন্ডিকেট সভা করেন। পরের দিন উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ ও প্রক্টরকে বিশ্ববিদ্যালয়ে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে শিক্ষক সমিতি। সেই সঙ্গে তাঁদের দপ্তরে তালা দেওয়া হয়।
২৭ এপ্রিল বিকেলে কোষাধ্যক্ষ মো. আসাদুজ্জামানকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে গাড়িসহ টানা তিন ঘণ্টা আটকে রাখে শিক্ষক সমিতি। পরদিন বেলা একটায় উপাচার্য নিজ দপ্তরে ঢুকতে যান। এই সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন ছাত্রলীগের সাবেক নেতারা। তখন উপাচার্যের পক্ষের লোকজন শিক্ষকদের কিলঘুষি মারেন বলে অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনায় শিক্ষক সমিতি উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ, প্রক্টরসহ ছাত্রলীগের সাবেক নেতাদের নামে থানায় অভিযোগ করেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও শিক্ষক নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে। ৩০ এপ্রিল রাতে সিন্ডিকেট সভায় অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় ও হল বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর মধ্যে ১২ মে রাতে সিন্ডিকেটের জরুরি সভা হয়। ওই সভায় বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়া নিয়ে আলোচনা হয়। কিন্তু সিন্ডিকেটের সদস্যরা কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি।
সর্বশেষ গতকাল রোববার দুপুরে প্রশাসনিক ভবনে এক আলোচনাসভা ডাকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। উপাচার্যের সঙ্গে ওই সভায় উপস্থিত হওয়ার জন্য শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে আলাদা করে চিঠি দেওয়া হয়। কিন্তু শিক্ষক সমিতি ওই সভা প্রত্যাখান করে পাল্টা চিঠি দেয়। শিক্ষক সমিতি জানিয়ে দেয়, বিশ্ববিদ্যালয় খোলা বা বন্ধ রাখার ব্যাপারে শিক্ষক সমিতির কোনো দায় নেই। উপাচার্য নিজেই বন্ধ করেছেন।
সিন্ডিকেটের সদস্য ও কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য মো. হুমায়ুন কবির বলেন, সিন্ডিকেটে বিশ্ববিদ্যালয় খোলা নিয়ে কোনো ধরনের সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায়নি। শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনা করার তাগিদ দেওয়া হয় সিন্ডিকেটে। দাবিদাওয়া নিয়ে গঠিত কমিটির কাজ নিয়ে কথা হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, ক্যাম্পাসে কৃষ্ণচূড়া, জারুল, সোনালু ও লাল সোনাইল ফুলের ছড়াছড়ি। ফুলের পাপড়ি ছড়ানো-ছিটানো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি সড়কে, পাশে লালমাই পাহাড়ের টিলায়। পুরো আঙিনায় সুনসান নীরবতা। নেই শিক্ষার্থীদের পদচারণ ও কোলাহল। হলগুলোতে কিছুসংখ্যক শিক্ষার্থী আছেন। বঙ্গবন্ধু হলের চার শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা হয়। তাঁদের একজন বলেন, ‘ঈদের ছুটির পর বাড়ি থেকে এসে বসে আছি। কোনো ক্লাস হচ্ছে না। তাই হলে আড্ডা দিয়ে সময় কাটাই।’
বিশ্ববিদ্যালয়ে অচলাবস্থায় হতাশা দেখা দিয়েছে অভিভাবকদের মধ্যেও। কুমিল্লা নগরের কচুয়া চৌমুহনী এলাকার অভিভাবক আমেনা বেগম বলেন, ‘বাড়ির কাছে বিশ্ববিদ্যালয়। মেয়েকে ভর্তি করালাম। কেবলই অস্থিরতা। মার্চ থেকে ক্লাস হচ্ছে না। ছোট মেয়েটা এবার ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন পরিস্থিতি থাকলে এখানে ভর্তি করাব না।’
সিন্ডিকেটের একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, শিক্ষকদের ওপর ছাত্রলীগ দিয়ে আক্রমণ করে বিশ্ববিদ্যালয় চালানো সম্ভব নয়। উপাচার্য ৩০ এপ্রিল জরুরি সিন্ডিকেট সভা করেছেন। কিন্তু তিনি সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন ৭ মে। দাবিদাওয়া ও শিক্ষকদের ওপর হামলা নিয়ে কমিটিও ওই দিন প্রকাশ করেন। পরে কমিটিগুলো কাজও শুরু করেনি। এ অবস্থায় শিক্ষার্থীদের পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে। শিক্ষকদের সঙ্গে বিরোধ করে বিশ্ববিদ্যালয় চালানো যায় না।
বিশ্ববিদ্যালয় কবে খুলবে, এ বিষয়ে কিছু বলতে পারছেন না সিন্ডিকেটের সদস্যসচিব ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার মো. আমিরুল হক চৌধুরী। অবিলম্বে বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক মো. আবু তাহের। তিনি বলেন, ‘আমরা সংবাদ সম্মেলন করে বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়ার দাবি জানিয়েছি। উপাচার্য মহোদয় সিন্ডিকেটে মিথ্যা তথ্য দিয়ে (হলে অস্ত্র আছে ও টাকা ছিটানো হচ্ছে) বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেন। বিশ্ববিদ্যালয় তো বন্ধ করার মতো অবস্থা হয়নি।’
এ বিষয়ে হোয়াটসঅ্যাপে প্রথম আলোর প্রশ্নের জবাবে এ এফ এম আবদুল মঈন বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় খোলার প্রক্রিয়া চলমান। শিক্ষকদের দাবি ও ২৮ এপ্রিলের ঘটনা নিয়ে দুটি কমিটি কাজ করছে। আশা করি, দ্রুত কমিটিগুলো তাদের কাজ সম্পন্ন করবে। আমি তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি এবং আশা করি, আমরা কয়েক দিনের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দিতে পারব। তবে এই প্রক্রিয়ায় সবার দায়িত্বশীল আচরণ করা আবশ্যক।’