শিশুসন্তানসহ নির্দোষ নারী ২২ ঘণ্টা থানা–হাজতে আটক, অভিযুক্ত এসআইয়ের শাস্তি দাবি

রংপুরের কাউনিয়া থানা–পুলিশের হয়রানির শিকার নারী শারমিন আক্তার ওরফে মমতাজ। শিশুসন্তান কোলে গত বৃহস্পতিবার দুপুরে রংপুর আদালত চত্বরে এসেছিলেন, তখন তোলা
ছবি: প্রথম আলো

প্রতারণার অভিযোগে আদালতের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছিল এক নারীর বিরুদ্ধে। পুলিশ তাঁর বদলে নির্দোষ এক নারীকে ধরে কোলের শিশুসহ ২২ ঘণ্টা থানা–হাজতে আটক রেখে আদালতে পাঠায়। ওই নারী আদালত থেকে জামিনে বেরিয়ে অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তার শাস্তির দাবি জানিয়েছেন। ঘটনাটি রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার। কাউনিয়া থানা-পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) রবিউল ইসলামের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ পাওয়া গেছে।

কাগজপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, প্রতারণার অভিযোগে ওই আদালতের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছিল মমতাজ বেগমের নামে। পরোয়ানায় তাঁর স্বামীর নাম রফিকুল ইসলাম, সাং কুর্শা, ডাকঘর, বড়ুয়াহাট, থানা কাউনিয়া লেখা রয়েছে। কিন্তু পুলিশ ওই মমতাজ বেগমের বদলে যাঁকে ধরেছিল, তাঁর নাম শারমিন আক্তার। স্বামীর নাম সেকেন্দার আলী। ইউনিয়ন কুর্শা, গ্রাম, চান্দঘাট, উপজেলা, কাউনিয়া। শারমিনের ডাকনাম মমতাজ।

আদালতে দায়ের করা মামলা আরজি সূত্রে জানা যায়, বেসরকারি সংস্থা টিএমএসএসের রংপুরের পীরগাছা উপজেলার অন্নদানগর শাখা থেকে রফিকুলের স্ত্রী মমতাজ বেগম ২০২১ সালের ৭ মার্চ ১ লাখ ২০ হাজার টাকা ঋণ নেন। সুদে-আসলে তা দাঁড়ায় ১ লাখ ৪২ হাজার ৯৫০ টাকায়। এ টাকা পরিশোধ না করায় প্রতারণার অভিযোগে মমতাজের বিরুদ্ধে ২০২২ সালের ২১ এপ্রিল রংপুরের সিনিয়র জুডিশিয়াল আদালত পীরগাছায় টিএমএসএসের কর্মকর্তা জিয়াউর রহমান মামলা করেন। এ মামলায় গত বছরের ২ মে ওই আদালত থেকে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়।

আদালতের ওই পরোয়ানামূলে ২২ জুন বিকেল চারটার দিকে কাউনিয়া থানার এসআই রবিউল ইসলাম প্রকৃত আসামি মমতাজ বেগমকে না ধরে শারমিন আক্তার ওরফে মমতাজ নামের ওই নির্দোষ নারীকে ধরে তাঁর কোলের শিশুসহ থানা–হাজতে আটকে রাখেন। ২৩ জুন বিকেলে থানা থেকে শারমিনকে আদালতে পাঠানো হলে আদালত তাঁকে জামিন দেন।

কুর্শা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ ঘটনাটি প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘পুলিশ আসলে ভুল করে প্রকৃত আসামিকে না ধরে নির্দোষ আরেক নারী আসামিকে ধরে আদালতে চালান দিয়েছিল। বিষয়টি বোধ হয় পুলিশের সঙ্গে মিটমাট হয়ে গেছে।’

গতকাল শুক্রবার দুপুরে শারমিন আক্তারের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, শারমিন ও তাঁর মা মর্জিনা বেগম বাড়িতে আছেন। তাঁদের চোখেমুখে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। মর্জিনা বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘পুলিশকে বলছি, আমার মেয়ে নির্দোষ, তার দুইটা শিশু বাচ্চা আছে, ছেড়ে দেন। তারপরও তাঁরা ছেড়ে দেন নাই। পুলিশ এত বড় অন্যায় করল, তাঁদের বিচার কি হবে না?’

থানায় নতুন লোকজন দেখে ভয়ে আমার বুকের দুধ খাওয়া শিশুটি অনেক কান্নাকাটি করেছে। আমিও খুব ভয় পেয়েছিলাম। থানা–হাজতে সারা রাত ঘুমাতে পারিনি। গরমে খুব কষ্টে রাত কেটেছে। বিনা দোষে শিশুসন্তানসহ আমাকে ২২ ঘণ্টা কেন থানা–হাজতে আটকে রাখা হলো? আমি এর কঠিন বিচার চাই।
শারমিন আক্তার, পুলিশের হয়রানির শিকার নারী

শারমিন আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর স্বামী সেকেন্দার আলী ঢাকায় বেসরকারি চাকরি করেন। গত কোরবানির ঈদে বাড়িতে এসে সেকেন্দার আলী ২২ জুন বিকেলে নিজ কর্মস্থলে ফিরে যাচ্ছিলেন। এ সময় স্থানীয় বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত এগিয়ে দিতে স্বামীর সঙ্গে স্ত্রী শারমিন আক্তারও সেখানে যান। বিকেল চারটার দিকে ওই বাসস্ট্যান্ডে স্বামীসহ তাঁকে সাদাপোশাকে কয়েকজন ঘিরে ধরে নাম-পরিচয় জিজ্ঞেস করেন। তাঁরা স্বামী-স্ত্রী নিজেদের পরিচয় দেন। পুলিশের এসআই রবিউল ইসলাম এ সময়ে হাতে থাকা কাগজে নামের ভিন্নতা পেয়ে শারমিনকে ধমকান এবং বলেন, ‘তোমার স্বামীর নাম সেকেন্দার নয়, রফিকুল ইসলাম।’ এর পরে স্বামীকে রেখে জোর করে শারমিনকে পুলিশের গাড়িতে তুলে থানায় নিয়ে যান ওই এসআই।

শারমিন আক্তারের অভিযোগ, ‘আমার ডাকনাম মমতাজ বেগম। কিন্তু আমার স্বামী, বাবার নাম ও ঠিকানা ভিন্ন থাকার পরও পুলিশ দুই বছরের শিশুসন্তানসহ আমাকে অন্যায়ভাবে থানা–হাজতে আটকে রাখে। এসআই রবিউল বলেন, আমার নামে আদালতে টাকা লেনদেনের মামলা আছে। এ সময় আমি পুলিশকে বারবার বলি, আমি কারও কাছে কখনো টাকা লেনদেন করিনি। কিন্তু পুলিশ আমার কথায় কর্ণপাত না করে ২২ জুন বিকেল ৪টা থেকে ২৩ জুন বেলা ২টা পর্যন্ত ২২ ঘণ্টা শিশুসন্তানসহ আমাকে থানা–হাজতে আটকে রেখে আদালতে চালান দেয়।’

শারমিন আক্তার আরও বলেন, এসআই রবিউল ইসলাম তাঁকে (শারমিন) শিখিয়ে দেন, আদালতে গিয়ে স্বামীর নাম সেকেন্দার আলীর বদলে রফিকুল ইসলাম বললে দ্রুত জামিন পাবেন। অন্যথায় জামিন হবে না। এ কারণে আদালতে ওই পরিচয়েই জামিন পেয়েছেন তিনি।

শারমিন আক্তার অভিযোগ করে বলেন, ‘হাজারবার পুলিশকে বলেছি, আমার নাম–ঠিকানা যাচাই করে দেখেন। আমি কারও কাছে কখনো টাকা নিইনি। আমার নামে কোনো মামলা নাই। কিন্তু পুলিশ আমার কিংবা আমার পরিবারের সদস্যদের কারও কোনো কথা শোনেনি। থানায় নতুন লোকজন দেখে ভয়ে আমার বুকের দুধ খাওয়া শিশুটি অনেক কান্নাকাটি করেছে। আমিও খুব ভয় পেয়েছিলাম। থানা–হাজতে সারা রাত ঘুমাতে পারিনি। গরমে খুব কষ্টে রাত কেটেছে। বিনা দোষে শিশুসন্তানসহ আমাকে ২২ ঘণ্টা কেন থানা–হাজতে আটকে রাখা হলো? আমি এর কঠিন বিচার চাই।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কুর্শার চান্দঘাট এলাকার একাধিক বাসিন্দা অভিযোগ করে বলেন, এসআই রবিউল টাকার জন্য সব করেন। বিনা কারণে মানুষকে ধরেন, টাকা দিলে ছেড়ে দেন। ভয়ে কেউ প্রতিবাদ করেন না।

যোগাযোগ করা হলে এসআই রবিউল ইসলাম শারমিন আক্তার ওরফে মমতাজ নির্দোষ বলে স্বীকার করেন। আজ শনিবার বিকেলে মুঠোফোনে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘পরে খোঁজ নিয়ে দেখেছি, যে নারীকে ধরে আদালতে চালান দিয়েছিলাম, তিনি আসলে ওই ওয়ারেন্টভুক্ত আসামি নন।’

তাঁর বিরুদ্ধে করা অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে এসআই রবিউল বলেন, ‘শারমিন আক্তার ওরফে মমতাজকে গ্রেপ্তারের সময়ে ওয়ারেন্টের কাগজ দেখানো হয়েছে। সব ঠিক আছে জানালে তখন তাঁকে থানায় এনে রেখে পরদিন আদালতে চালান দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে ভুল হয়েছে তাঁর, আমার নয়।’

কাউনিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহফুজার রহমান বলেন, ‘ঘটনাটি একটু ভুল–বোঝাবুঝি ছিল। পরে বিষয়টি ভুক্তভোগী নারীর সঙ্গে মিটমাট হয়ে গেছে।’ রংপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ডিএসবি, মিডিয়া উইং) ইফতে খায়ের আলম মুঠোফোনে বলেন, ‘ঘটনাটি আমরা শুনেছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত কেউ আমাদের কাছে লিখিত অভিযোগ দেননি। অভিযোগ পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’