‘যে জন দিবসে মনের হরষে...’ কবির স্মৃতিস্তম্ভ ঘিরে ছাগলের খামার
‘যে জন দিবসে মনের হরষে জ্বালায় মোমের বাতি’, ‘চির সুখী জন ভ্রমে কি কখন, ব্যথিত বেদন বুঝিতে কি পারে’—এমন সব নীতি কবিতার মধ্য দিয়ে বাংলা সাহিত্যে পরিচিত কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার। খুলনার দিঘলিয়া উপজেলার সেনহাটীতে সেই কবির জন্মস্থানের স্মৃতিচিহ্নগুলো পড়ে আছে অযত্ন আর অবহেলায়। অবহেলা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে কবির স্মৃতিস্তম্ভ ঘিরে গড়ে উঠেছে ছাগলের খামার।
গতকাল সোমবার দুপুরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একটি ভিডিও পোস্ট করেন কৃষ্ণচন্দ্র ইনস্টিটিউটের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শেখ মনিরুল ইসলাম। ওই ভিডিওতে দেখা যায়, কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের স্মৃতিস্তম্ভ ঘিরে একটি ছাগলের খামার গড়ে উঠেছে। কাঠের কাঠামোর ওপর একচালা টিনের ছাউনি। স্মৃতিস্তম্ভ মাঝখানে রেখে চারপাশ কাঠের চটা দিয়ে ঘেরা। স্মৃতিস্তম্ভের মাথায় কাটা ঘাস স্তূপ করে রাখা। কয়েকটি ছাগল সেই ঘাস খাচ্ছে। সামনে সবজির খেত।
ওই ভিডিওর সূত্র ধরে সোমবার বিকেলে সেনহাটী গ্রামের শিববাড়ি মন্দির চত্বরে গিয়ে দেখা যায়, ছাগলগুলো সেখান থেকে বের করে সামনে বেঁধে রাখা হয়েছে। খামারের টিনের চালা খুলে একপাশে সরিয়ে রাখা। খুঁটিগুলোও তুলে ফেলা হয়েছে। তবে তখনো স্মৃতিস্তম্ভের চারপাশে ছাগলের বর্জ্য রয়েছে। আর স্মৃতিস্তম্ভের সামনের অংশ ঘিরে করা হয়েছে সবজির খেত। রুস্তুম আলী মৃধা নামে স্থানীয় এক ব্যক্তি এসব করেছেন।
সরেজমিনে ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সেনহাটী বাজারের অদূরে ভৈরব নদের তীরসংলগ্ন শিববাড়ি মন্দির চত্বর। একই চত্বরে কয়েকটি মন্দির আছে। চত্বরের এক কোনায় একটি কামিনী গাছ ছিল। গাছটির নিচে বসে কবি লিখতেন। কবির জীবনের একমাত্র যে ছবি পাওয়া যায়, তা সেই কামিনী গাছের নিচে বসেই তোলা। কামিনী গাছের পাশে কবির স্মৃতিস্তম্ভ করা হয় ১৩৩৩ বঙ্গাব্দে। স্মৃতিস্তম্ভে লেখা আছে কবির লেখা কবিতার দুটি লাইন ‘ওহে মৃত্যু, তুমি মোরে কী দেখাও ভয়, ও ভয়ে কম্পিত নয় আমার হৃদয়’।
আর কবির প্রিয় কামিনীগাছের স্মৃতি রক্ষার্থে ২০০৮ সালের জুলাইয়ে দ্বিতীয় আরেকটি কামিনী গাছ রোপণ করেন খুলনার সে সময়ের জেলা প্রশাসক এস এম ফিরোজ আলম।
কৃষ্ণচন্দ্র ইনস্টিটিউটের সাধারণ সম্পাদক শেখ মনিরুল ইসলাম বলেন, কবির বসতভিটা ও পুকুর অনেক আগেই দখল হয়ে গেছে। সেনহাটীতে কবির স্মৃতিচিহ্ন বলতে এখন শুধু স্মৃতিস্তম্ভ ও একটি ইনস্টিটিউট আছে। স্মৃতিস্তম্ভ ঘিরে ছাগলের খামারের দৃশ্য হতাশ করে।
শিববাড়ী মন্দির কমিটির সভাপতি রমেশ কুমার দাশ প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রায় পাঁচ বছর ধরে এখানে ছাগল রাখা হচ্ছে। দুর্গাপূজার সময় আমরা ছাগলের ঘর সরিয়ে দিয়েছিলাম। পরে আবার ছাগল রাখছেন তিনি। তাঁকে বহুবার বলা হলেও কথা কানে তোলেন না। আমরা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ। আমাদের এখানকার বহু সম্পত্তি বেদখল হয়ে গেছে। আমরা ভয়ে খুব বেশি কিছু বলি না।’
অভিযোগের বিষয়ে রুস্তুম আলী মৃধা প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাজারঘাটের বিভিন্ন লোকজন এখানে আসেন। প্রস্রাব-পায়খানা করে যান। আমি যেহেতু পাশেই থাকি, এ জন্য অসুবিধা হয়। তাই ঘিরে রেখেছি। আমার চারটা ছাগল ঘাস কেটে খাওয়াই। আমাকে কেউ না কেউ তো এখানে রাখার অনুমতি দিয়েছেন, না হলে তো রাখতে পারতাম না।’ তবে অনুমতি কে দিয়েছেন, সে বিষয়ে তিনি কিছু বলেননি।
দিঘলিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মাহবুবুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘কবির স্মৃতিবিজড়িত জায়গাটা অরক্ষিত। আমরা অনেক চেষ্টা করেও তেমন কিছু করতে পারছি না। জায়গার মালিকানা মন্দিরের। কবির স্মৃতি ধরে রাখার জন্য মন্দির থেকে স্মৃতিস্তম্ভের জায়গাটা আলাদা করতে পারলে সংরক্ষণ করতে সুবিধা হতো। তবে সেখানে ছাগল পালনটা কোনোভাবে মানা যায় না। এ ব্যাপারে শিগগিরই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
ভৈরব নদের তীরে খুলনার দিঘলিয়া উপজেলার সেনহাটীতে কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার জন্মগ্রহণ করেন ১৮৩৪ সালের ১০ জুন। ১৮৬১ সালে তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘সদ্ভাব শতক’ প্রকাশিত হয়। কবিতা লেখার পাশাপাশি শিক্ষকতা ও সাংবাদিকতা করেছেন কৃষ্ণচন্দ্র। ‘ঢাকা প্রকাশ’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন তিনি। ১৯০৭ সালের ১৩ জানুয়ারি তিনি মারা যান।