গোটা দুনিয়া ভাসছে ফুটবলের উন্মাদনায়। সেই উন্মদনা ছড়িয়ে পড়েছে প্রত্যন্ত গ্রামের কোনায় কোনায়। আজ শুক্রবার সাতসকালে খুলনার ভৈরব নদের বার্মাশীল খেয়াঘাট পার হয়ে দিঘলিয়া উপজেলার সেনহাটি গ্রামে পৌঁছাতেই উন্মাদনার আঁচ টের পাওয়া গেল।
খেয়াঘাট থেকে শুরু করে যতই সামনের দিকে এগোনো হলো, কিছুদূর পরপর ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনার বড় বড় পতাকা পতপত করে উড়ছে। মাঝেমধ্যে কিছু ফ্রান্স ও পর্তুগালের পতাকারও দেখা মিলল। রাস্তায় চলাফেলা করা মানুষের বড় একটা অংশের পরনেই প্রিয় দলের জার্সি। জার্সি পরে কাজে যাচ্ছেন। ঘুরে বেড়াচ্ছেন। মোড়ে মোড়ে, দোকানে দোকানে আলোচনায় শুধু ফুটবল। মেসি-নেইমারদের সফলতা-ব্যর্থতা, অর্জন আর না পাওয়ার গল্প, আড্ডা আর তর্ক-বিতর্ক।
সেনহাটি মোড় থেকে কিছুদূর সামনে এগোতেই কলের পুকুরপাড় মোড়। পুকুরের বড় পাকা ঘাটলার সামনে পুকুরের মধ্যেই বড় পর্দায় খেলা দেখার ব্যবস্থা রেখেছেন স্থানীয় লোকজন। পর্দার দুই প্রান্তে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার বড় বড় দুটি পতাকা ঝুলছে।
পুকুরপাড়ের ওয়ার্কশপের দোকানদার মো. নাসিম জানালেন, স্থানীয় ইউপি সদস্য, দোকানদার, চাকরিজীবী—সবাই মিলে এই বড় পর্দার ব্যবস্থা করেছে। খেলার সময় পুরো রাস্তা ব্লকড হয়ে যায়। আর আজ তো ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা দুই দলেরই খেলা। খেলা ব্যাপক জমবে। দুই দলের সমর্থকেরাই উন্মুখ হয়ে আছেন।
কলের পুকুর মোড় থেকে কিছুটা সামনে কাগজী বটতলা বাঁশেরহাট মোড়। মোড়ের ওপর বড় বড় পতাকা উড়ছে। সমর্থকদের ছবি দিয়ে প্যানা করা রয়েছে। সেখানকার চায়ের দোকানে দুই দলের সমর্থকদের মধ্যে চলছে তর্ক-বিতর্ক।
বাঁশেরহাট মোড় থেকে সামনে পানিগাতি পশ্চিমপাড়া গ্রামের সাদেকের বটতলা। মোড়ের রাস্তার মাঝে প্রচীন বটগাছের চারদিকে চারটা রাস্তা চলে গেছে। গাছের নিচে ইটের পাকা বেদি করে বসার জায়গা। বেদির গায়ে পরপর ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার পতাকা আঁকানো। মোড়ের ওপর আল্পনা আঁকা হয়েছে। পাশের দোকানগুলোতে রংতুলি দিয়ে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা পতাকা আর মেসি–নেইমারদের ছবি আঁকা হয়েছে। বেদির নিচে বসে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার জনা দশেক সমর্থক তুমুল তর্কে লিপ্ত। মূলত তর্কে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন আর্জেন্টিনার সমর্থক আবদুল্লাহ আর ব্রাজিলের সমর্থক শেখ রিয়াজ হোসেন।
আমরা আয়োজন করেছি এক শ মানুষের। তেহারি হবে। আগের দিন আর্জেনিটনার খেলার দিনও ছিল। সেদিন ব্রাজিল সমর্থকদেরও খাইয়েছি। সবাই তো ভাই-ব্রাদার। একসঙ্গে খেলা দেখি।
রিয়াজ হোসেন আবদুল্লাহকে বলছিলেন, ‘তোমরা এত ভালো দল। তোমাদের ভিন গ্রহের প্লেয়ার তো পেনাল্টি মিস করে। শোনো শুধু শুধু তর্ক করো না, বিশ্বে যত দল আছে ব্রাজিলের মতো অত তারকাবহুল প্লেয়ার তো কোনো দলে নেই।’ আবদুল্লার পাল্টা জবাব, ‘মিস তো করতেই পারে। মেসি তো পরে জিতাইছে। আর আপনারা যতই পাঁচবারের গল্প দেন না কেন, আপনারা তো মূলত বিশ্বকাপ জিতেছেন দুইবার, বাকি তিনবার তো জুলে রিমে কাপ।’ পাশ থেকে ব্রাজিল সমর্থক মোশারফ হোসেন বলে ওঠেন, ‘ওই মিয়া, তাহলে ব্রাজিলের জার্সিতে পাঁচ তারকা লাগানো হইছে কীভাবে। হাত দিয়ে গোল দিয়ে বড় কথা কও। আর কথায় কথায় সাত গোলের কথা কও। নিজের যোগ্যতায় তো সাত গোল দেওনি।’ আবদুল্লাও কম যান না। মোশারফের কথার পিঠে বললেন, ‘ওই স্টার দিয়ে বসে থাকেন। আর হাত দিয়ে গোল দিতে যোগ্যতা লাগে। যার কাছেই খান, সেভেন আপ তো খাইছেন। আর গায়ে বল লাগার আগে জবাই করা মুরগির মতো লাফায় আপনাদের নেইমার।’
ব্রাজিলের একজন সমর্থক বলে উঠলেন, ‘লেভেলে আসো। তোমাদের তো কোনো লেভেল নাই, নিজেদের তো কিছু নেই। অর্জন বলতে ওই সেভেন আপ।’
তর্ক-বিতর্কের মধ্যেই দুই দলের অনেকেই হাজির হয়ে যান। মোড়ের ওপর দিয়ে পথের বাজারে বাজার করতে যাচ্ছিলেন রহমত গাজী ও দাউদ শেখ। তর্ক দেখে রহমত গাজী সাইকেল থামিয়ে বললেন, ‘ওসব গল্পে, ইতিহাস-ফিতিহাসে কাজ হবে না। মাঠে আসো খেলা হবে। আর্জেন্টিনা কম করে চার গোল দেবে।’ দাউদ শেখও সাইকেলে থেকেই বলে উঠলেন, ‘অতো লাফাইয়ো না। আমাদের কাছেই দুই গোল খাইছো, দেখো আজ কি হয়।’ দাউদ জানালেন তিনি সৌদি আরবের সমর্থক।
তর্ক-বিতর্ক যেন আর থামে না। তুমুল তর্কের মধ্যে এক অপরকে পরাস্ত করতে মুঠোফোনে নেট ঘেঁটে পুরোনো ইতিহাস ঘাঁটার চেষ্টায় মরিয়া দুই দলের সমর্থকেরা। এর মধ্যেই টিভিতে বিশ্বকাপের খবর শুরু হলো। সবাই দোকানের টিভির সামনে এলেন। দোকানের টিভি থাকার পরও খেলা দেখার জন্য সমর্থকেরা মিলে টিভি কিনেছেন। খেলার খবর শেষ হতেই দুই দলের সমর্থকেরা ব্যস্ত হয় পড়লেন রাতের খাবারের আয়োজনের প্রস্তুতি নিতে।
মোশারফ হোসেন বলেন, চার বছর পরপর খেলা হয়। ফুটবল সবাই বোঝে। প্রতিটা মুহূর্তেই উন্মাদনা থাকে। রাস্তার ওপর বসে অনেকে খেলা দেখেন। খাওয়াদাওয়া চলে। আজকে রাতেও বড় খাওয়ার আয়োজন আছে। আর দল যদি জিতে যায়, কাল আরও বড় করে খাওয়ার আয়োজন চলবে। এখানে খেলার সময় খাওয়াদাওয়া বেশি হয়। প্রতি মোড়ে আয়োজন থাকে।
আজ দুই দলের সমর্থকদেরই প্রত্যাশা নিজ নিজ দলের জয়। তারপরও খেলার উন্মাদনা যাতে খেলার মধ্যেই থাকে সে ব্যাপারে সমর্থকেরা বেশ সচেষ্ট।
পাশে থাকা ফাতেমা মেমোরিয়াল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক আর্জেন্টিনার সমর্থক মনজুরুল হাসান বলেন, পথের বাজার মাঠে সকালে খেলা হয়েছে। আর্জেন্টিনার লোকজন সেখানে চার গোল দিয়ে ব্রাজিলের কাছ থেকে হাজার টাকা জিতে নিয়েছে। টান টান উত্তেজনা। সবাই মিলে দেখবেন। আর্জেন্টিনা তো জিতবেই। তিনি চান ব্রাজিলও জিতুক। সেমি ফাইনালে তাহলে সেয়ানে সেয়ানে লড়াই হবে।
ওয়ার্ড স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি আবু বক্কর বলেন, ‘আমরা আয়োজন করেছি এক শ মানুষের। তেহারি হবে। আগের দিন আর্জেনিটনার খেলার দিনও ছিল। সেদিন ব্রাজিল সমর্থকদেরও খাইয়েছি। সবাই তো ভাই-ব্রাদার। একসঙ্গে খেলা দেখি। ব্রাজিল গোল খাইলে আমরা আনন্দে ফেটে পড়ি। আমরা হেরে গেলে তাঁরা উল্লাস করে।’
ফাতেমা মেমোরিয়াল বিদ্যালয়ের শিক্ষক ব্রাজিলের সমর্থক ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘এখানে প্রচুর উন্মাদনা। প্রতি খেলায় পিকনিকের আয়োজন হয়। গতকাল রাতে রাজহাঁসের আয়োজন ছিল। আজকেও আয়োজন হবে। সকালই আমরা সাড়ে চার হাজার টাকা উঠিয়েছি। রাতে পিকনিক হবে। বাজার করা হয়ে গেছে।’
আজ দুই দলের সমর্থকদেরই প্রত্যাশা নিজ নিজ দলের জয়। তারপরও খেলার উন্মাদনা যাতে খেলার মধ্যেই থাকে সে ব্যাপারে সমর্থকেরা বেশ সচেষ্ট। রিয়াজ হোসেন যেমন বলছিলেন, ‘খেলায় চরম উন্মাদনা আছে। সব সময় থাকবে। আমরা পচাব, হয়তো আবার পচানি খাব। আরপরও সব সময় আমরা সচেষ্ট থাকি, খেলা যেন খেলার মধ্যেই থাকে। খেলা শেষে, রাত শেষে আমরা তো সবাই ভাই ভাই, প্রতিবেশী। মেসি–নেইমারের মধ্যে যদি অটুট বন্ধুত্ব থাকতে পারে, আমরা কেন এর বাইরে ভাবব।’