ব্রিটিশ, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ—তিনটি কাল দেখেছেন আবদুল আজিজ তালুকদার (৮৯)। তাঁর রাজনৈতিক সঙ্গীরা তাঁকে ‘কমরেড আবদুল আজিজ’ নামে ডাকেন। তাঁর সংগ্রামী জীবন শুরু হয় ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময়। তখন তিনি কিশোরগঞ্জের এক কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র। প্রত্যন্ত এ জেলাতেও তখন ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ দাবিতে স্লোগান দেওয়া হয়।
সদা হাস্যোজ্জ্বল লড়াকু মানুষটি বেড়ে উঠেছেন নেত্রকোনার পূর্বধলা উপজেলার বৈরাটি ইউনিয়নের দিননগর গ্রামে। তিনি ওই গ্রামের প্রয়াত অসমত উদ্দিন ও আখের বানু দম্পতির ছয় সন্তানের মধ্যে সবার বড়। ৭২ বছর পর তাঁর স্মৃতিতে ভাষা আন্দোলনের সেই দিনগুলো এখনো অম্লান।
আবদুল আজিজ জানান, ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা দেন—বাংলার পরিবর্তে উর্দুই হবে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। এই ঘোষণার প্রতিবাদে বাঙালিরা ক্ষোভে ফেটে পড়েন। প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে সে আন্দোলন। তখন থেকে তিনি বিষয়টি নিয়ে ভাবতেন।
১৯৫২ সালে আন্দোলন জোরালো হয়। তিনি তখন কিশোরগঞ্জ গুরুদয়াল কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির বিজ্ঞান শাখার ছাত্র। এ সময় সহপাঠী হেলাল উদ্দিন, বয়োজ্যেষ্ঠ আবু তাহের খান পাঠানসহ অনেককে নিয়ে মিছিল-সভা করেন। ওই সময় কিশোরগঞ্জ শহরের একটি মসজিদের ইমাম ছিলেন আতাহার আলী। তিনি সহযোদ্ধাদের নিয়ে তাঁর নেতা আতাহার আলীর সঙ্গে পরামর্শ করে সংগ্রাম উজ্জীবিত করতে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করতেন। তাঁরা বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে শিক্ষার্থীদের নিয়ে সভা করে আন্দোলন সম্পর্কে সচেতন করেন। তাঁদের এসব আন্দোলনে শিক্ষকসহ সাধারণ মানুষও অংশ নিতেন বলে জানান আজিজ।
আবদুল আজিজ বলেন, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগানে তাঁরা বিক্ষোভ চালিয়ে যান কিশোরগঞ্জ শহরে। প্রতিদিন শহরের রামানন্দ বিদ্যালয়, আজিম উদ্দিন উচ্চবিদ্যালয়, গুরুদয়াল কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তিন–চার শ শিক্ষার্থী মিছিলে যোগ দিত। মিছিল শেষে শহীদি মসজিদসংলগ্ন খোলা জায়গায় প্রতিবাদ সমাবেশ হতো। এ সময় পুলিশ তাঁকে ধরার চেষ্টা করলে তিনি কিছুদিন আত্মগোপন করেন। কিন্তু লুকিয়ে লুকিয়ে ভাষার জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যান।
পড়াশোনা শেষ করে কর্মজীবন শুরু করেন আবদুল আজিজ। তিনি চার দশকের বেশি সময় শিক্ষকতা করেছেন। সবশেষ ময়মনসিংহ শহরের রাধা সুন্দরী উচ্চবিদ্যালয় থেকে ১৯৯৪ সালে অবসরে যান। আজিজ তালুকদার বলেন, তিনি কিশোরগঞ্জ থাকাবস্থায় প্রখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা ওয়ালী নেওয়াজ খানের সঙ্গে পরিচিত হন। তাঁর সুবাদে কমিউনিস্ট নেতা গঙ্গেশ সরকার, জমিয়ত আলি, যতীন সরকার, শাহ আবদুল মোতালেব, ওয়াজেদ আলী, আজিজুর ইসলাম খানসহ অনেকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়। তিনি ১৯৯২ সাল থেকে টানা ৩৪ বছর ময়মনসিংহ কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে সদস্য হিসেবে রয়েছেন।
আবদুল আজিজ আক্ষেপ করে বলেন, এখন দেশের দলগুলোতে রাজনৈতিক শিক্ষা নেই, শিষ্টাচার ও সম্প্রীতি নেই। আর এত আন্দোলন সংগ্রামে, রক্তে জেতা বাংলা ভাষার প্রতি চরম অবজ্ঞা চলছে। এ অবজ্ঞা মেনে নিতে কষ্ট হয়।
যে ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সংগ্রামী জীবন শুরু হলো, সে সম্পর্কে কিছু জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘জীবনের চরম উত্তাল সময় পেরিয়ে গেলেও আমার চাওয়া–পাওয়ার কিছুই নেই, ছিলও না। তবে যে ভাষার জন্য আন্দোলন করেছি, এত শ্রম ও সময় ব্যয় করেছি, কতজন জীবন দিয়েছেন, তার অপব্যবহার দেখলে খুব কষ্ট হয়। এখনো বাংলা সর্বত্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি, ইংরেজির প্রাধান্য। মৃত্যুর আগে কি আমি বাংলার সর্বত্র ব্যবহার দেখে যেতে পারব?’